পরিবারের দেড় বিঘা জমি বাবা বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন মেয়ের ভিন রাজ্যে নার্সিং প্রশিক্ষণের জন্য। চাষ হতো একবার। কিন্তু ঘরের খোরাকি হতো। সেই জমিও রাখতে পারেনি পরিবার। বাড়ির মেয়ের নার্স হওয়ার স্বপ্ন পূরণের জন্য ভিন রাজ্যের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের খরচ মেটাতে জমির টাকা গেছে। নন্দীগ্রামের কয়েক হাজার পরিযায়ী শ্রমিকের একজন ভাই সুব্রত। চেন্নাইয়ে কাজ করেন বেশ কয়েক বছর। তাঁরও স্বপ্ন ছিল বোন নার্স হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে।
নন্দীগ্রামের গোকুলনগরের সেই যুবতীকে ঘিরে গরিব কৃষক পরিবারের আশা ধুলিসাৎ হয়ে গেছে সিঙ্গুরে। গোকুলনগরের যে গ্রামে নিহত তরুণী নার্সের বাড়ি, সেই এলাকার পঞ্চায়েত সদস্য প্রদীপ মণ্ডল রবিবার ক্ষোভে ফুঁসছিলেন। তিনি বললেন, “সিঙ্গুরের ওই নার্সিং হোমের মালিকের সঙ্গে মন্ত্রী বেচারাম মান্নার দহরম মহরম। আমাদের সঙ্গে সিঙ্গুর থানার পুলিশ যে দুর্ব্যবহার করেছে তা ভাবা যায় না। আমরা সিপিএম- এর আমলে পুলিশ দেখেছি। তখন আমাদের নন্দীগ্রামে আন্দোলন হয়েছে। এমন শুনিনি। যাঁর মেয়ে মারা গেছে, সেই বাবা, মা-র সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করেছে সিঙ্গুরের পুলিশ। আমরা শেষ দেখব।”
নন্দীগ্রামের সোনাচুড়া লাগোয়া গোকুলনগর ফুঁসছে পুলিশের বিরুদ্ধে।
নিহত তরুণীর এক আত্মীয় এদিন বলেন, “সিঙ্গুরের মানুষ আমাদের জানিয়েছেন ওই নার্সিং হোমটির নানা কুকীর্তি নিয়ে। আমাদের সিঙ্গুরের মানুষ জানিয়েছেন যে, যেদিন দীপালী(নিহত নার্স) - এর দেহ পাওয়া গেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে, সেদিন রাত ১০-সাড়ে ১০ টা নাগাদ ওই নার্সিং হোম থেকে ধরাধরি করে একজনের দেহ বের করা হয়েছিল। ওই নার্সিং হোমে নাকি আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। তখন রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য সিঙ্গুরের এমএলএ ছিলেন।”
এই বিষয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা হয়েছিল রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের অন্যতম রাষ্ট্র মন্ত্রী বেচারাম মান্নার সঙ্গে। তাঁর ফোন বেজে গেছে।
তবে সিঙ্গুরের যে নার্সিং হোমে তরুণী নার্সের দেহ মিলেছে সেই নার্সিং হোমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের অভিযোগ আছে। এমন নানা অভিযোগ গোকুলনগরের মানুষেরও। ওই নার্সিং হোমে মৃত্যুর মাত্র তিনদিন আগে কাজে যুক্ত হয়েছিল নন্দীগ্রামের ওই তরুণী। ঘটনার দু’দিন পরেও নন্দীগ্রামের ডাকসাইটে তৃণমূল নেতারা কেউ নিহত নার্সের বাড়ির আশেপাশে যাননি। ওই ঘটনা নিয়ে তৃণমূলের কোনও নেতা মুখ খুলতে চাইছেন না। নিহতের শেষকৃত্য হয়েছে শনিবার রাতে। তখন নন্দীগ্রাম থানার পুলিশ চুপচাপ এসে দাঁড়িয়েছিল বলে গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন।
নন্দীগ্রামের এমন অনেক যুবতী নার্সিং প্রশিক্ষণ নিতে ভিন রাজ্যে যান। লাগোয়া সোনাচূড়ার এক তৃণমূল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান,“আশেপাশে কেন, দুই মেদিনীপুর, হাওড়া সহ আশেপাশের কোনও জেলাতে ভালো নার্সিং ট্রেনিং সেন্টার নেই। তাই এখানকার মেয়েরা বাইরে যান। পরিবারগুলি নিজেদের জমি বিক্রি করে টাকা জোগাড় করে। এখানে ছেলেদেরও কাজ নেই। চেন্নাই, কেরালা, ব্যাঙ্গালোর, দিল্লিতে অনেকেই থাকেন। এখানে তো কাজ নেই। এখন যদি এই পরিবারের সন্তানদের কাজের নিরাপত্তা আমাদের রাজ্যেই না থাকে, তাহলে আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েরা যাবে কোথায়?”
গোকুলনগরের গ্রামবাসীরা নিহত তরুণীর
পোস্টমর্টেম রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে আছেন। নিহতের বাবা ইতিমধ্যেই সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখে গ্রামবাসীরা পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করবেন বলে এদিন জানিয়েছেন প্রদীপ মণ্ডল।
সিপিআই (এম) নেতা মহাদেব ভুঁইয়া রবিবার বলেন, ‘‘পরিবার যা দাবি করবে, আমাদের তা নিয়ে কিছু বলার নেই। কিন্তু নন্দীগ্রামের ছেলে মেয়েদের এই অনিশ্চিয়তা হয়েছে তৃণমূলের জন্য। আজ যারা বিজেপি, সেদিন তাঁরা সবাই তৃণমূলেই ছিলেন। এমনকি আজ যিনি নন্দীগ্রামের বিজেপি-র প্রতীকে নির্বাচিত বিধায়ক, তিনি ছিলেন তৃণমূলের প্রধান নেতা নন্দীগ্রাম সহ পূর্ব মেদিনীপুরের। তাদের বিশৃঙ্খলা, রাস্তা কাটা, মাইন পোঁতার রাজনীতি নন্দীগ্রামকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে। আমরা এই খুনের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছি। আমরা নিহত তরুণীর পরিবারের পাশে আছি।”
পাশে আছে পুরো নন্দীগ্রাম। কালীচরণপুরের শেখ সাহনাওয়াজ বলেছেন,”আমি নন্দীগ্রামের অনেক দিনের বাসিন্দা। এমন ঘটনা দেখিনি। পুলিশ জোর করে মৃতদেহ টেনে নিয়ে যাচ্ছে, এমন দৃশ্য কখনো দেখিনি। পুলিশ এটা করলো কী করে?”
Nandigram
ফুঁসছে গ্রাম, ভাই পরিযায়ী, জমি বেচেছে পরিবার, নন্দীগ্রামের মেয়ের স্বপ্ন ধ্বংস সিঙ্গুরে

×
Comments :0