DTPS Closed

দুর্গাপুর তাপবিদ্যুতের শেষ ইউনিটটিও বন্ধ করে দিল ডিভিসি

রাজ্য

DTPS Closed

অবশেষে আশঙ্কা সত্যি হলো। শিল্পশহর দুর্গাপুরে আরও একটি সাড়া জাগানো শিল্পে অচলাবস্থা তৈরি হলো। ডিভিসি’র দুর্গাপুর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের (ডিটিপিএস) সবেধন নীলমণি ২১০ মেগাওয়াটের ৪ নম্বর ইউনিটটিও পাকাপাকিভাবে বন্ধ করে দেওয়ার ফরমান জারি করা হয়েছে। এই প্রথম ডিভিসি কর্তৃপক্ষ তার কোনও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পুরোপুরি অচল করে দিল।


কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রকের সেন্ট্রাল ইলেকট্রিসিটি অথরিটি (সিইএ)-র সচিব রাকেশ গোয়েলের স্বাক্ষরিত নির্দেশে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, অল ইন্ডিয়া ইন্সটল্‌ড ক্যাপাসিটি ডাটাবেস থেকে ডিটিপিএস’র ২১০ মেগাওয়াটের ৪ নম্বর ইউনিটটি অপসারণ করা হলো (পত্রসংখ্যা সিইএ-পিএল-১৪-৩৮/৫/২০২২, তারিখ ১৯/১২/২০২২)। ওয়ারিয়া রেল স্টেশনের পাশে ডিটিপিএস’র খাঁচাটি পড়ে রয়েছে।


তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আয়ু গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ বছর। বোকারোতে ডিভিসি’র পুরানো ইউনিট বাতিল করার আগেই সেখানে নতুন ইউনিট তৈরি করা হয়েছে। পরপর ৭টি ইউনিট হয়েছে বোকারো তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে। চন্দ্রপুরা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রেও তা-ই হয়েছে। পরপর ৮টি ইউনিট হয়েছে সেখানে। প্রোজেক্ট বরাবর চালু রয়েছে। ব্যতিক্রম ডিটিপিএস’র বেলায়। নতুন ৫ নম্বর ইউনিট তৈরি না করেই প্ল্যান্ট স্তব্ধ করে দেওয়া হলো! 

 


ডিভিসি গড়ে ওঠার প্রথম দিকের প্রকল্প ডিটিপিএস। ১৯৫৫ সালে দুর্গাপুর ব্যারেজ নির্মাণ করা হয়। ১৯৬০ সালে ৭৫ মেগাওয়াটের দু’টি ইউনিট নিয়ে ডিটিপিএস চালু হয়। ১৯৮৫ সালে ইউনিট দু’টি বন্ধ হয়ে যায়। তার আগেই ১৯৬৭ সালে তৈরি হয়েছে ১৪০ মেগাওয়াটের তৃতীয় ইউনিট। ২০১৬ সালে এই ইউনিটটি বন্ধ হয়। তৃতীয় ইউনিটের সময়কালের মধ্যেই ১৯৮২ সালে মাথা তুলেছে ২১০ মেগাওয়াটের চতুর্থ ইউনিট। 
ডিটিপিএস-এ পঞ্চম ইউনিটের প্রয়োজনীয়তা বহু দিনের আলোচ্য বিষয়। ২০১২ সালে ৫০০ মেগাওয়াটের পঞ্চম ইউনিটের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়। মায়াবাজার রেল ক্রসিংয়ের উপর সেতু তৈরির প্রস্তাবও ছিল। সেই প্রস্তাব অনুমোদন পায়নি। এদিকে ডিটিপিএস বন্ধ্যাত্বের দিকে এগিয়ে চলেছে। প্রায় ৪০ বছরের ৪ নম্বর ইউনিট বাতিল হবে, এটা নিশ্চিত। ইতিমধ্যে পরিবেশ দপ্তরের ছাড়পত্র না পেয়ে উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়েছে কিছু দিন। 


নতুন ৫ নম্বর ইউনিটের দাবিতে সবাই সোচ্চার হয়েছেন। গড়ে উঠেছে ডিটিপিএস বাঁচাও কমিটি। শ্রমিক-কর্মচারীরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন ইতিমধ্যেই। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলে ডিটিপিএস-এ ৮০০ মেগাওয়াটের পঞ্চম ইউনিট তৈরির নীতিগত সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কাজ শুরুর কোনও উদ্যোগ নেই। বলা হচ্ছে, রঘুনাথপুরে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার পর ডিপিটিএস নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা হবে। রঘুনাথপুরের কাজ শেষ হতে মনে করা হচ্ছে, পাঁচ বছর লেগে যাবে। অর্থাৎ আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ডিটিপিএস-এ নতুন কিছু হচ্ছে না। আপাতত ৮০০ মেগাওয়াটের খুড়োর কল ঝুলিয়ে ডিটিপিএস-কে শিকেয় তোলা হলো!
দুর্গাপুর নগর নিগমের ৩৬ এবং ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের জনজীবনের অর্থনৈতিক সচলতার সঙ্গে ডিটিপিএস’র সম্পর্ক জড়িয়ে রয়েছে। প্রায় ২০০ স্থায়ী শ্রমিক এবং প্রায় ৮০০ ঠিকা শ্রমিক রয়েছেন ডিটিপিএস-এ। আগামী আর্থিক বছরের প্রথম মাস এপ্রিল থেকে ডিটিপিএস’র জন্য বাজেট বরাদ্দ হবে না। ঠিকা শ্রমিকরা কাজ হারাবেন। স্থায়ী শ্রমিকদের অন্যত্র চালু প্রোজেক্টে বদলি করা হবে। 
ডিটিপিএস কলোনিতে রয়েছে হাসপাতাল, সিভিল অফিস, হাই স্কুল, বিদ্যুতের সাব-স্টেশন, মেইন্টেন্যান্স অফিস, পাঞ্জাব ন্যাশানাল ব্যাঙ্কের শাখা, ডিটিপিএস’র লোকজনদের জন্য গড়ে ওঠা মায়াবাজার এলাকা এবং ডিভিসি’র অনেক আবাসন নিয়ে আবাসিক এলাকা। অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক-কর্মচারীরাও অনেকে বসবাস করছেন আবাসনে। এর জন্য তাদের ২০ গুন বেশি ভাড়া দিতে হয়। 


এই রাজ্যের শাসক দলের মদতপুষ্ট মাতব্বররা ইতিমধ্যেই লুটপাট শুরু করে দিয়েছে। ডিটিপিএস কলোনির প্রায় ৬০ শতাংশ খালি আবাসনের দখল নিয়ে ভাড়ায় খাটানো হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, কোথাও কোথাও অগ্রিম বাবদ ৫০ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়েছে। ডিভিসি কর্তৃপক্ষ এই অনৈতিক দখলদারির বিরুদ্ধে থানায় একটাও এফআইআর করেনি। কর্তৃপক্ষ একবার পানীয় জলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিল। হুমকির মুখে আবার লাইন জুড়ে দিতে হয়েছে। পাশাপাশি অভিযোগ, কর্তৃপক্ষ সমস্ত আবাসন দখলদারদের জন্য উন্মুক্ত করতে চায়। তাই অবসরপ্রাপ্তদের আবাসন খালি করার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। শাসক দলের একাংশের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের একাংশের যোগসাজশ নিয়েও অভিযোগ উঠেছে। তৃণমূলের স্থানীয় মাতব্বরদের একেক জনের আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। 
জোরালো দাবি উঠেছে দুর্গাপুর জুড়ে, অবিলম্বে পঞ্চম ইউনিটের কাজ শুরু করতে হবে। ডিটিপিএস-কে স্তব্ধ করে দেওয়া চলবে না। হাসপাতাল, বিদ্যালয় বন্ধ করা চলবে না। আবাসন দখলদার মুক্ত করতে হবে। অবসরপ্রাপ্তদের আবাসন থেকে উচ্ছেদ করা চলবে না। দুর্গাপুর ব্যারাজের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। ছাঁটাই নয়, ঠিকা শ্রমিকদের বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। ডিটিপিএস বাঁচাও কমিটি বলেছে, ডিটিপিএস উৎপাদনহীন হলে জনজীবনে গভীর সঙ্কট নেমে আসবে। জল সঙ্কট হবে। এলাকার অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। 


কর্তৃপক্ষ কোল স্টক ইয়ার্ড চালু রেখেছে। এখান থেকে ডাম্পার বোঝাই হয়ে কয়লা যাচ্ছে মেজিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে, যদিও মেজিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা নিয়ে যাওয়ার জন্য রানিগঞ্জ থেকে আলাদা রেললাইনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রেল ওয়াগনে মেজিয়াতে কয়লা পরিবহণ করা হচ্ছিল। কিছু ঠিকা শ্রমিককে কোল স্টক ইয়ার্ডে কাজ দিয়ে কর্তৃপক্ষ বিক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য এটা করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এখানেও লুট এবং দুর্নীতি মাথাচাড়া দিয়েছে বলে অভিযোগ। মানুষের একটাই দাবি, কাগজে নয়, বাস্তবে নতুন পঞ্চম ইউনিট চাই। প্রকল্প গুটিয়ে দেওয়া চলবে না। 
 

 

Comments :0

Login to leave a comment