Bangladesh

পুড়ি কিন্তু মরি না

আন্তর্জাতিক

বখতিয়ার আবিদ চৌধুরি

পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্র চর্চা ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে উপেক্ষিত এবং নিষিদ্ধ। বিশেষত আইয়ুব খানের শাসন কালে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের মানুষ রবীন্দ্র চর্চায় প্রথম যে বাধাটি পায়--সেটি ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপনে; কিন্তু আইয়ুব খান ও তার পেটোয়া মৌলবাদীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাঙালি সাংস্কৃতিমনা প্রগতিশীল সংগঠকরা ঢাকায় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপন করেন। এরপর বাঙালি সাংস্কৃতিমনা প্রগতিশীল ওই সংগঠকরা একটি সুসংগঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন, এর প্রেক্ষিতে তৈরী হয় ‘ছায়ানট’। নেতৃত্বে ছিলেন মোখলেসুর রহমান, শামসুন্নাহার রহমান, সুফিয়া কামাল, ওয়াহিদুল হক, কামাল লোহানী, সনজীদা খাতুন প্রমুখ। এরপর ছায়ানট কেবলই এগিয়ে গেছে, বাংলার জমিনে ছড়িয়ে দিয়েছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বাউল, ভাটিয়ালির সুর। 
ছায়ানট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রায় আট বছরের মাথায় ১৯৬৮ সালে বিপ্লবী কথাশিল্পী সত্যেন সেন, রণেশ দাসগুপ্ত প্রমুখের নেতৃত্বে বিপ্লবের স্পৃহা ধারণ করে গঠিত হয় ‘উদীচী শিল্পগোষ্ঠি’। প্রতিষ্ঠার পর সমাজতন্ত্রের দীক্ষায় দীক্ষিত উদীচীর কর্মীরা হাটে, মাঠে, বন্দরে গণসঙ্গীতের উতলা স্রোত বইয়ে দিয়েছেন। গানে গানে কৃষক-শ্রমিক মেহনতি জনতাকে করেছেন অধিকার সচেতন। তাদের সম্মিলিত কণ্ঠের উদ্ধত গণসঙ্গীত যেমন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি ও মৌলবাদের আঁতুড়ঘরের ভীত কাঁপিয়েছে, তেমনি সুপ্ত ভাবে জনগণের ভেতর সমাজ প্রগতির লড়াইয়ের বীজ বুনেছে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠির শোষণ, বৈষম্য ও অত্যাচারের শৃঙ্খল ভেঙে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়ায়। মুক্তিযুদ্ধে ছায়ানট ও উদীচীর শিল্পীরা ছিলেন কণ্ঠযোদ্ধার ভূমিকায়। তাঁরা দেশাত্মবোধক ও জাগরণমূলক গানে মুক্তিযোদ্ধাদের ৯টি মাস উজ্জীবিত রেখেছেন, লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। সাংস্কৃতিক লড়াইকে ত্বরান্বিত করতে জোরালো ভূমিকা রাখায় এ দু’টি সংগঠন তাদের জন্মলগ্ন থেকেই মৌলবাদীদের চক্ষুশূল। 
স্বাধীনতার পর বহুবার, বিভিন্ন ভাবে ছায়ানট ও উদীচী আক্রান্ত হয়েছে। ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোর টাউন হলো মাঠে উদীচীর অনুষ্ঠানে বাউল গানের আসরে উগ্রপন্থীদের দুই দফা বোমা বিস্ফোরণে ১০ জন সাংস্কৃতিক কর্মী ও দর্শক নিহত হন। ২০০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর উদীচীর নেত্রকোনা কার্যালয়ের সামনে আত্মঘাতী বোমা হামলা ঘটায় উগ্রপন্থী সংগঠন জেএমবি। সে ঘটনায় নিহত হন আট জন। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে উগ্রপন্থীদের বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হন। এই প্রাণঘাতি হামলার পরেও কিন্তু ছায়ানট ও উদীচীর শিল্পী, কর্মীরা দমে যাননি। তাঁরা তাদের লড়াই জারি রেখেছিলেন। মৌলবাদীরাও যে বসে ছিল তা নয়, তারা সুযোগের অপেক্ষায় থেকেছে। সে সুযোগটি তাদের সামনে এসে যায় গত ১৮ ডিসেম্বর; দুষ্কৃতীকারীদের গুলিতে আহত ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য নির্দলীয় প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর। সে রাতেই পরিকল্পিতভাবে দৈনিক ‘প্রথম আলো’, ‘ডেইলি স্টার’ অফিস জ্বলিয়ে দেওয়া হয়। একই সময় হামলা করা হয় ছায়ানট ভবনে। তাদের অভিযোগ, এই প্রতিষ্ঠানগুলি ভারতের হয়ে কাজ করে!  
সে রাতে ছায়ানট ভবন ভেঙে চুরমার করা হয়েছে; পর দিন উদীচীর অফিস পুড়িয়ে ভস্মীভূত করা হয়েছে। ছায়ানটে সনজীদা খাতুনের একটি ছবি বিকৃত করে মৌলবাদীরা। সে ছবি এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এ ঘটনা প্রমাণ করে মৌলবাদীরা বহুদিন ধরে এই হিংস্র ক্ষোভ পুষে রেখেছে। গত দু’ দিন তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটল মাত্র। ছায়ানট, উদীচীর ওপর মৌলবাদীদের আক্রোশ যে পুরানো এবং এই হামলা যে পরিকল্পিত, তার প্রমাণ ১৮ ডিসেম্বর রাতে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিবিরের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমানের ‘বাম, শাহবাগি, ছায়ানট, উদীচীকে তছনছ করে দেওয়া’র ঘোষণা। 
জামায়াত-শিবির ভালো করেই জানে, এ দেশে তাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ছায়ানট এবং উদীচী অন্যতম বড় বাধা। এ দু’টি সংগঠনকে ভেঙে দিতে পারলেই শিল্প-সংস্কৃতির ময়দানে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য অনেকখানি অর্জিত হবে। কিন্তু তারা এটা ভুলে গেছে যে, ছায়ানট এবং উদীচীর শেকড় এ দেশের মাটির অনেক গভীরে। বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সংগঠন দু’ টির নাম। ওরা এটাও ভুলে গেছে, আজ থেকে ৫৪ বছর আগে বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক আপামর জনতা ওদের যখন পরাজিত করেছিল, ছায়ানট এবং উদীচী সেই জনতার সঙ্গে জোট বেঁধে লড়াই করেছে।  
দু’ বছর ধরে ধারাবাহিক ভাবে সারা দেশে সুফি দরগা এবং বাউলদের আখড়ায় পরিকল্পিত হামলা চালিয়ে আসছে মৌলবাদীরা। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর হুকুম চালানোর আকাঙ্ক্ষা মৌলবাদীদের পুরানো, সেই সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মিতালী রয়েছে, এমন কোনো স্থাপনাও তারা রাখতে চায় না। ছায়ানট এবং উদীচীতে চালানো ধ্বংসযজ্ঞ ওই হামলার সঙ্গে সম্পর্কিত। ওরা ধীরে ধীরে এগচ্ছে, ওদের চূড়ান্ত লক্ষ্য এ দেশের বাম-কমিউনিস্ট-সমাজতন্ত্রীরা। বাংলাদেশের বাস্তবতায় মৌলবাদীরা প্রথমে কমিউনিস্টদের ধরতে পারবে না। কারণ কমিউনিস্টরা মিশে আছেন এ দেশের মাটি, পানি, বাঙালি, আদিবাসী নিপীড়িত জনতার সঙ্গে। তাই ওদের প্রথমে এই সবকিছুকে ধ্বংস করতে হবে। কিন্তু কমিউনিস্টরা তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। ওদের পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞের প্রথম দিন থেকেই কমিউনিস্টরা প্রতিবাদে ও প্রতিরোধের বার্তা নিয়ে রাজপথে সোচ্চার রয়েছেন। হ্যাঁ, তাঁরা সংখ্যায় কম, কিন্তু তাঁরা তৎপর, সদা সতর্ক অতন্দ্র প্রহরী দেশের মা-মাটি-মোহনার। তাই ছায়ানট-উদীচী পোড়ানো যায়, কিন্তু তার চেতনাকে খতম করা যায় না।

 লেখক : সাংবাদিক

Comments :0

Login to leave a comment