Editorial, sushanta ghosh

সাহসী প্রতিরোধের পদযাত্রা সুশান্ত ঘোষ

সম্পাদকীয় বিভাগ

 

১৯৭৭ সালে প্রথম জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার শপথ গ্রহণ করে। শপথ গ্রহণের দিনই সাংবাদিক সম্মেলনে , সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে নতুন সরকারের কাজের অগ্রাধিকারের ভিত্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, “ আমাদের সরকার গ্রাম বাংলার উন্নয়নের হাতিয়ার হিসাবে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেবে। রাইটার্স বিল্ডিংয়ে বসে সরকার চলবে না। আমরা গ্রাম বাংলা পর্যন্ত বিকেন্দ্রীভূতভাবে সরকার পরিচালনা করবো, গ্রামের মানুষ পরিকল্পনা ও উন্নয়নে সরাসরি অংশগ্রহণ করবে এই ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে”। এই ঘোষণার এক বছরের মধ্যেই ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যদিও এই নির্বাচন আটকানোর জন্য সেই সময়ের বিরোধী রাজনৈতিক দল যতরকম  জটিলতা সৃষ্টি করা যায়, হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্ট সব রকম জটিলতা সৃষ্টি করে। আইনি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সেই জটিলতা অতিক্রম করে বাংলার মানুষ পঞ্চায়েতে অংশগ্রহণ করেন । 
            গ্রামের শোষিত, বঞ্চিত মানুষ এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়– এক কথায় শ্রেণি ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের অল্প ব্যবধানেই ১৯৭৮ সালের ভয়ঙ্কর বন্যাকে মোকাবিলার কাজে নবনির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্যরা সরকারের সহায়তায় গৌরবজনক ভূমিকা পালন করেন। এতবড় বিপর্যয়ের পরে সরকারের সদিচ্ছা ও পঞ্চায়েতের ভূমিকায় নতুন ইতিহাস তৈরি হয়। গ্রামাঞ্চলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় আগে যারা ছিল বিচারপ্রার্থী তারা বিচারকের আসনে পৌঁছে যান, যাঁরা ছিলেন বিচারক তারা হয়ে যান বিচারপ্রার্থী।

এই সমগ্র পরিকল্পনায় কমরেড জ্যোতি বসু , কমরেড বিনয় চৌধুরি ছিলেন পুরোধা। এই পঞ্চায়েতকে হাতিয়ার করেই লক্ষ লক্ষ একর আইন বহির্ভূত উদ্বৃত্ত জমি ‘খাস’ ঘোষণা করে সেই জমি ভূমিহীন কৃষকদের বণ্টনের মধ্যে দিয়েই কৃষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ভাগপ্রথায় যে চাষ হতো, ভাগচাষির কোনও আইনগত  অধিকার ছিল না। এই প্রথম পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় “ অপারেশন বর্গার” মধ্যে দিয়ে ভাগচাষিরা আইনগত  অধিকার পেলেন, যা জমি আন্দোলনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। সারা বাংলায় ৩২ লক্ষ বর্গাচাষির নাম রেকর্ডভুক্ত হয়। কৃষি কাজে যখন খেতমজুরের কোনও কাজ থাকে না তখন যে অবর্ণনীয় দুরবস্থা সৃষ্টি হতো,  তার থেকে মুক্তি পেতে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে অবলম্বন করে ‘ ফুড ফর ওয়ার্ক ‘ ব্যবস্থা তৈরি হয়, এর দায়িত্ব পড়ে পঞ্চায়েতের ওপরে ।
    পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সামগ্রিকভাবে সারা বাংলার অর্থনৈতিক ভারসাম্য পরিবর্তনের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। মানুষের জমি পাওয়া, স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ পাওয়া কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে রেকর্ড পরিমাণ অগ্রগতি ঘটে। সারা দেশের ক্ষেত্রেও আমাদের খাদ্য ও কৃষি উৎপাদন উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে। বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমরা ছিলাম সামনের সারিতে। অব্যবহৃত জমিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নতুন নতুন উদ্ভাবনী কাজের মাধ্যমে বাংলার অর্থনীতির ক্ষেত্রকে  প্রসারিত করার দায়িত্ব নেয় পঞ্চায়েত, এর অনেক দৃষ্টান্ত আছে। 
মানুষের ক্রয়ক্ষমতার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ঘটে। বিশ্ববিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক নোয়াম চমস্কিও বাংলার এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তৎকালীন  দেশের প্রধানমন্ত্রী আমাদের রাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে দেশের মধ্যে মডেল পঞ্চায়েত হিসাবে উল্লেখ করেন। 
মানুষ প্রতি ৫ বছর অন্তর নিয়ম মেনে মানুষ নিজের পঞ্চায়েত গড়ার অধিকার প্রয়োগ করতে পারতেন এই বাংলায়। এককথায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই মানুষের অধিকার বোধ ও গণতান্ত্রিক  অধিকার বৃদ্ধি হয়। অর্থনৈতিক অগ্রগতি, শিক্ষা গ্রহণের সুযোগের ব্যাপ্তি ঘটে এই বাংলায় ।
       ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক, জাতীয় এবং রাজ্যগত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির গভীর ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে বামফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার ফলে এখন সেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থা রাজ্যের শাসক দলের চুরি, দুর্নীতি, লুটের প্রধান হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সাধারণ মানুষের সাথে এই পঞ্চায়েতের কোনও সম্পর্ক নেই। শাসক দল নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম রাখার জন্য, লুটতন্ত্রের অধিকার নিজেদের এক্তিয়ারে রাখার জন্য ২০১৩ সাল থেকে যতগুলি পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছে, গণতন্ত্রের কোনও সুযোগ রাখেনি। তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার জন্য যে সব পন্থা নিয়েছে তাতে বাংলার মান সম্মান ভূলুন্ঠিত হয়েছে দেশের মানুষের সামনে। প্রয়াত খ্যাতনামা কবি শঙ্খ ঘোষকেও এই অরাজকতার পঞ্চায়েত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কলম ধরতে হয়েছে । তাঁর কলম থেকেই সেদিন বেরিয়েছিল– 
“...দেখ খুলে তোর তিন নয়ন,
রাস্তা জুড়ে খড়গ হাতে 
দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন।'

৩৪ বছরের শেষের দিকে পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় হয়তো কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি ঘটেছিল। এ কথা অস্বীকার করলে বাস্তবকে অস্বীকার করা হবে। তবে সেসব সরকারের নজরে এলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সরকার দ্বিধা করেনি। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত সরকারি আধিকারিকরা পঞ্চায়েত ব্যবস্থা যথাযথ পালনের জন্য ভূমিকা পালন করতেন। এখন পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় যুক্ত আধিকারিকেরাও শাসক দলের প্রত্যক্ষ মদতে  এই দুর্নীতি  লুটের অংশীদার হয়ে গেলেন। তাদের প্রত্যক্ষ মদতে যুক্ত জনপ্রতিনিধি থেকে আধিকারিকেরা নীতিহীনতার এক একজন দিকপাল হয়ে পড়লেন ।

যে পঞ্চায়েত মানুষের আশা ভরসার পঞ্চায়েত ছিল , সেই পঞ্চায়েতকে ঘিরেই নানান স্তরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ, বিক্ষোভ ঢেকে রাখার সুযোগ শাসকদলের নেই। রেগা প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। এই প্রকল্প বন্ধের কারণ ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি দুর্নীতির এই সরকার হিসাব না দিতে পারায় কেন্দ্রীয় সরকার অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করেছে বলে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ। ৬ মাস, ৮ মাস এমনকি ১০ মাস পর্যন্ত রেগায় বকেয়া রয়েছে, মানুষ তার ন্যায্য প্রাপ্য পাচ্ছে না। নতুন করে পাট্টা ও বর্গা রেকর্ড তো দুরের কথ, পঞ্চায়েতের মাধ্যমে যতগুলি প্রকল্প রূপায়িত হতো (জব কার্ড, গ্রাম সড়ক যোজনা, গৃহ আবাস যোজনা ) সমস্ত ক্ষেত্রেই কাটমানির টাকা না দিতে পারলে কোনও কাজ হচ্ছে না। এমনকি জব কার্ড  হোল্ডারদের কাছ থেকেও জানা যায়, কাজ না করেও তাদের অ্যাকাউন্টে যে টাকা ঢোকে তার একটা ভালো অংশ শাসকদলকে দিতে হয় ।
     বাম সরকারের সময়ে পঞ্চায়েতকে হাতিয়ার করে যে কোটি কোটি টাকার সামাজিক বন সৃজনের মাধ্যমে সম্পদ তৈরি হয়েছিল, শাসকদলের লুটেরা রা তা সমস্ত শেষ করে দিয়েছে। গ্রামাঞ্চলের বালি, পাথর থেকে শুরু করে শাসক দলের প্রত্যক্ষ মদতে সর্বস্ব লুট হচ্ছে। কখনো কখনো রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসককেও প্রশাসনের বিরুদ্ধে উষ্মাপ্রকাশ করতে দেখা গেছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি, মানুষের কাছে নিজের ভাবমূর্তি ধরে রাখতে কপট উষ্মা প্রকাশ মানুষ  বুঝতে পারছেন ।

এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনের লড়াই গ্রামাঞ্চলের গরিব খেটে খাওয়া মানুষের জেহাদ বর্তমান শাসক দলের চোর লুটেরারদের হাত থেকে পঞ্চায়েতকে পুনরুদ্ধার করার লড়াই। “ গ্রাম জাগাও – চোর তাড়াও , রাজ্য বাঁচাও” এই স্লোগানেই রাজ্যে চলছে পদযাত্রা। কৃষক – শ্রমিক – খেতমজুর সংগঠনের সমন্বয়ে এবং অন্যান্য সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে এক নতুন অধ্যায় রচিত হবে ।
  শাসক দলও চুপ করে বসে নেই। তারা তাদের লুটের পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে কীভাবে ধরে রাখতে পারবে– তার জন্য তারাও মরিয়া চেষ্টা চালাবে। শাসক দলের এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে জনগণের অধিকার ফিরে পাওয়ার যে লড়াই তা প্রতিবাদ থেকে প্রতিরোধে উন্নীত করাই হলো এই পদযাত্রার মূল উদ্দেশ্য। পদযাত্রা বানচাল করার জন্য শাসকদল কোথাও কোথাও নির্লজ্জতার চূড়ান্তভাবে আত্মপ্রকাশ করবে। বিগত ১০ বছর ধরে যেভাবে তারা পুলিশ ও সাধারণ প্রশাসনকে নির্লজ্জভাবে ব্যবহারের দৃষ্টান্ত  যে বাংলায় তারা কায়েম করেছে তাকে ব্যবহারের করতেও পিছপা হবে না । কিন্তু এবারের লড়াই হবে চোখে চোখ রেখে। একথা আমাদের সংগ্রামে শামিল সমস্ত কর্মীদের স্মরণে রাখতে হবে। রাজ্যজুড়ে লাল ঝান্ডার কর্মসূচিতে মানুষের যে উন্মাদনা তা আমাদের আত্মবিশ্বাসকে  অনেকদূর এগিয়ে দিচ্ছে– প্রতিদিন শাসকদলের দুর্নীতির যে ঘটনা সাধারণ মানুষের সামনে আসছে, যার ফলে শাসকদল মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারছে না। সাধারণ মানুষ অনেক দূরে। দুষ্কৃতীরা বর্তমানে এই সরকারকে ক্ষমতায় ধরে রাখতে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করছে। সাধারণ ও পুলিশ প্রশাসনের একাংশের তরফে শাসকদলের পক্ষে যে অবস্থান ছিল সেই অবস্থানও বদলাতে শুরু করেছে। আমাদের পদযাত্রায় যত বেশি বেশি সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণ ঘটবে ,তত বর্তমান শাসকদলের সাথে থাকা মানুষের অবস্থানের পরিবর্তনেও সহায়ক হবে। 
    গত ১ নভেম্বর থেকে রাজ্যজুড়ে গ্রাম থেকে গ্রামে, পাড়ায় পদযাত্রা শুরু হয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাতেও ৪৯৮টি পদযাত্রা হবে পরিকল্পনা হয়েছে, দিন যত এগোচ্ছে এই প্রত্যয় আমাদের বাড়ছে যে এই সংখ্যার মধ্যে পদযাত্রা সীমাবদ্ধ থাকবে না, সংখ্যা বাড়বে। ২০১১ সালের পর থেকে যেসমস্ত জায়গায় আমাদের প্রবেশের সুযোগ ছিল না, সেরকম অনেক নতুন নতুন জায়গায় মানুষকে সাথে নিয়ে এবারে পদযাত্রাগুলি সংগঠিত করা  হচ্ছে। সারা মাসব্যাপী এই কর্মসূচি চলবে। আমাদের পদযাত্রার অভিজ্ঞতা হলো, যে সংখ্যক মানুষকে নিয়ে পদযাত্রা শুরু হচ্ছে চলার পথে নতুন মানুষ যুক্ত হওয়ার ফলে সেই সংখ্যা অনেকটা বাড়ছে, যারা নানান কারণে সরাসরি অংশ নিতে পারছেন না— মিছিল দেখে গ্রামের মধ্যে তাঁরাও বেরিয়ে এসে উৎসাহিত করছেন। এর ফলে পদযাত্রীদের মনোবল অনেকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে ।
  আমাদের সমস্ত গণসংগঠনের সর্বস্তরে যুক্ত সকলকেই আহ্বান জানানো হয়েছে। জানি আড়ষ্টতা অনেক। কেন এই আড়ষ্টতা তা সর্বজনবিদিত। মিথ্যা মামলা, হামলা, দৈহিক অত্যাচার, জরিমানার দগদ্গে ক্ষত এখনও কর্মী সমর্থকরা মুছে ফেলতে পারেননি– না পারারই কথা। এত সহজে কি ভোলা যায়?
        কিন্তু যখন কৃতকর্মের কারণে রাজ্যের শাসকদল মানুষের বিশ্বাসের জায়গা থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে, মানুষ তখন চাইছে আবার লাল ঝান্ডা ফিরে আসুক। রাজ্য ও দিল্লি– উভয়  চোর, লুটেরাদের সরকার এরা মানুষের কল্যাণ করতে পারে না। তাই, মানুষ যখন চাইছে আবার লাল ঝান্ডা ফিরে আসুক তখন আমাদের তো দায়িত্ব পালন করতেই হবে । পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে পায়ের তলায় মাটি শক্ত করার লড়াই এ আমরা সবাই শামিল। এই লড়াইয়ের মূল আহ্বান এটাই, ‘ লড়বো আমরা–জিতবো আমরা’।

Comments :0

Login to leave a comment