Families of Migrant Workers

উৎসবের রোশনাইয়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিবারের অন্দরেই আঁধার

জেলা

কৌশিক দাম
শরতের আগমন। শহর থেকে গ্রামে উৎসবের কৃত্রিম আবেশের ঘনঘটা। মণ্ডপে ব্যয়বহুল আলোকসজ্জা, ঢাকের বাজনার শব্দ আর বাজারে তথাকথিত সাফল্যের মিথ্যা বিজ্ঞাপন। কিন্তু জলপাইগুড়ির বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারের কাছে এই আনন্দ স্রেফ প্রহসন। রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার অন্ধকারে ডুবে থাকা এই পরিবারগুলির কাছে উৎসব মানেই কষ্টের নিত্যস্মৃতি। শ্রমিক-খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি শাসক শ্রেণির চরম উদাসীনতার বাস্তব চিত্র উঠে এল বানারহাটের চা বাগান লাগোয়া এক শ্রমিক মহল্লায়। বছর ছয়েক আগে রেললাইনের ধারে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন সুরেশ ওঁরাও। একটি হাত হারিয়ে তখন থেকে কর্মক্ষমতা হারিয়ে বিছানাতেই তাঁর দিন কাটছে। পরিবারটির সামাজিক সুরক্ষা বা সুনিশ্চিত পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা করেনি সরকার। তাঁর স্ত্রী ললিতা মুন্ডা বললেন, “ছেলেমেয়ের জন্য নতুন জামার স্বপ্ন দেখি ঠিকই। কিন্তু স্বপ্নটাই থেকে যায়। প্রতিদিনের ভাতের যোগাড়ই দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।” 
একই করুণ দশা ময়নাগুড়ি ব্লকের ধারাইকুড়ির বাসিন্দা ইসমাইল হকের পরিবারের। বছর দু’য়েক আগে দিল্লিতে কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ নিখোঁজ হন তিনি। পুলিশ-প্রশাসন বা সরকারি তরফে তেমন কোনো সহযোগিতা মেলেনি। বহু খোঁজাখুঁজি করেও কোনো খোঁজ মেলেনি। স্ত্রী হাসনা বেগমের আক্ষেপ, “আমার ছেলে এবার ক্লাস ফোরে পড়ছে। পুজোয় বন্ধুদের মতো নতুন জামা চাইবে, কিন্তু আমি দিতে পারব না। স্বামীর নিখোঁজ হওয়ার পর সংসারই অচল হয়ে গেছে। প্রশাসনের টনক নড়েনি।” 
এই হাহাকার শুধু সুরেশ বা ইসমাইলের ঘরে নয়—ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, বানারহাট, ক্রান্তি—জলপাইগুড়ির শ্রমজীবী মানুষের সব জায়গাতেই একই ছবি। ঘরে ঘরে লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ছাপ। স্থায়ী কাজের অভাব, লুটেরা নীতির ফল বারবার সরকারি স্তরে লোক-দেখানো ‘ঘরে ফেরার’ ডাক দেওয়া হলেও স্থানীয় স্তরে উৎপাদনশীল কাজের সুযোগ নেই বললেই চলে। চা বাগানে অস্থায়ী ও অনিশ্চিত কাজ ছাড়া অন্য কোনও নির্ভরযোগ্য কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। ভূমি সংস্কারের ব্যর্থতা, বৃহৎ শিল্পের প্রতি সরকারের তোষণ এবং ক্ষুদ্র শিল্পের প্রতি অনীহার কারণে প্রতিনিয়ত যুবকরা পেটের টানে দিল্লি, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র বা দক্ষিণ ভারতের শহরে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছেন। সেখানে ন্যূনতম নিরাপত্তা ছাড়াই কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনা, অসুস্থতা বা শোষণের শিকার হয়ে অনেকেই আর ফিরে আসেন না। শ্রম আইন লঙ্ঘিত হয় দিনের পর দিন।
মুখ্যমন্ত্রীর তথাকথিত ‘শ্রমশ্রী’ প্রকল্প এবং ‘ঘরে ফেরার’ ডাক কি সত্যিই এই বঞ্চনার মূলে আঘাত হানতে পারবে? নাকি এগুলিও শাসক দলের রাজনৈতিক ফন্দি ও ভোটের কৌশল হিসাবেই থেকে যাবে? সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমেই কি তবে এই পরিবারগুলির ন্যায্য অধিকার ও স্থায়ী কাজের বন্দোবস্ত সুনিশ্চিত হবে? প্রতি বছরই কি পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারগুলি একইভাবে উৎসবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে থাকবে—প্রশ্ন তুলছে জেলার সাধারণ মানুষ ও বামপন্থী গণসংগঠনগুলি।

Comments :0

Login to leave a comment