বাংলাদেশে একজন হিন্দু শ্রমিককে মৌলবাদীদের নৃশংস হত্যার ঘটনার প্রতিবাদের নামে মঙ্গলবার দেশের নানা প্রান্তে যখন নৈরাজ্য তৈরি করেছে হিন্দুত্ববাদীরা। সেই সময়েই হিন্দুত্ববাদীদের হাতে একইভাবে খুন হওয়া মহম্মদ আখলাকের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা বন্ধ করার উত্তর প্রদেশের বিজেপি সরকারের আবেদন খারিজ করে দিল আদালত। সিপিআই(এম) নেত্রী বৃন্দা কারাত আদালতের এই নির্দেশকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, এই নির্দেশ উত্তর প্রদেশ সরকারের গালে একটা চপেটাঘাত।
গ্রেটার নয়ডা জেলা আদালত এদিন আখলাককে পিটিয়ে হত্যার মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য রাজ্যের আবেদন খারিজ করে দেয়। উল্টে আদালত মামলাটির দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়ে প্রতিদিন শুনানির আদেশ দিয়েছে। আদালত বলেছে, ‘‘গৌতম বুদ্ধ নগরের পুলিশ কমিশনার ও গ্রেটার নয়ডার ডেপুটি কমিশনারকে চিঠি পাঠানো হোক, যাতে মামলার সমস্ত প্রমাণের যথাযথ সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়।” অতিরিক্ত জেলা বিচারক সৌরভ দ্বিবেদী মামলাটিকে ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ হিসেবে নথিভুক্ত করার নির্দেশ দেন এবং প্রতিদিন শুনানির কথা বলেন। তিনি আরও নির্দেশ দেন, যত দ্রুত সম্ভব মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করতে হবে। মামলার পরবর্তী শুনানি হবে ৬ জানুয়ারি।
২০১৫ সালের ২৮ নভেম্বর উত্তর প্রদেশের গৌতম বুদ্ধ নগর (গ্রেটার নয়ডা)-র জেলার দাদরির বিসাহড়া গ্রামের বাসিন্দা ৫৫ বছর বয়সি মহম্মদ আখলাককে হিন্দুত্ববাদী উন্মত্ত মব নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। তার ঘরে গোরুর মাংস আছে বলে অভিযোগ করে এই হামলা করা হয়। তাঁর ছেলে দানিশকেও হত্যার চেষ্টা করে হিন্দুত্ববাদী মব বাহিনী। সঙ্কটজনক অবস্থায় দীর্ঘদিন হাসপাতালে ভর্তি থেকে প্রাণে বাঁচেন দানিশ। আখলাকের বৃদ্ধা মা, স্ত্রী, মেয়ে- কেউ রেহাই পাননি হিন্দুত্ববাহিনীর ‘মব’ হামলা থেকে। সকলকে মারধর করে হিন্দুত্ববাদীরা। কেন্দ্রে মোদী সরকার আসার পরে ‘মব’ সন্ত্রাস এবং ‘মব লিঞ্চিং’ অর্থাৎ ভিড় জুটিয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার সেই শুরু। বাংলাদেশে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে যেভাবে ইসলামিক মৌলবাদী মব নৃশংসভাবে হত্যা করেছে দীপু দাসকে, একইভাবে গোরু এবং গোমাংসের নামে গত এক দশকে দেশের নানা প্রান্তে হিন্দুত্ববাদীরা হত্যা করেছে সংখ্যালঘুদের। মূলত মুসলিমদের। কোথাও কোথাও খ্রিস্টান এবং আদিবাসীরাও আক্রান্ত হয়েছেন। কেন্দ্র ও রাজ্যের বিজেপি সরকারগুলির পরোক্ষে মদত এবং নেতাদের সরাসরি উস্কানিতে মোদী জমানায় ভারতে ‘মবতন্ত্র’ প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা পায়। গত ১১বছরে অন্তত দুশোর মত মানুষকে শুধু গোরুর নামে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন আরও বেশি। তার সূত্রপাত এই আখলাক হত্যার ঘটনা দিয়ে। বিজেপি দল হিসাবে এবং পরবর্তীকালে উত্তর প্রদেশের আদিত্যনাথ সরকার সরাসরি খুনের অভিযুক্তদের পক্ষ নেয়। দশ বছর ধরে এই মামলার তেমন অগ্রগতি হয়নি। অপরাধীরা সবাই জামিনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখন সরকার আদালতে আবেদন করে সমস্ত অভিযোগ প্রত্যাহার করে মামলাই তুলে নেওয়ার আবেদন করেছিল!
আখলাকের পরিবারের পাশাপাশি সিপিআই(এম) নেত্রী বৃন্দা কারাত উত্তর প্রদেশ সরকারের এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি শুরু থেকেই আখলাকের পরিবারের সঙ্গে আছেন। এই নিয়ে তিনি রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকেও চিঠি দেন। সেখানে তিনি উত্তর প্রদেশের রাজ্যপালের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে বলেছিলেন, সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হত্যার অভিযোগও প্রত্যাহার করে নিতে চাইছে সরকার, আর সেখানে আপত্তি না জানিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তে শিলমোহর দিচ্ছেন রাজ্যপাল! রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন তিনি। যদিও রাষ্ট্রপতি এই নিয়ে কোনও কথা বলেননি। কিন্তু আদালত এদিন এক লহমায় সরকারের আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। আদালতের নির্দেশের পরে সিপিআই(এম) নেত্রী বৃন্দা কারাত বলেছেন, আদালতের এই নির্দেশ ন্যায়ের পথে একটি বড় পদক্ষেপ এবং সরকারের গালে কষিয়ে চড়। হত্যা, হত্যার চেষ্টার মতো গুরুতর অভিযোগ তুলে নিয়ে অভিযুক্তদের ছাড় দেওয়ার চেষ্টা করছিল উত্তর প্রদেশ সরকার। এই নির্দেশের ফলে অন্যান্য রাজ্যের ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার মবতন্ত্রের হত্যায় অভিযুক্তদের ছাড়িয়ে নেওয়ার কোনোধরনের চেষ্টাও বাধাপ্রাপ্ত হবে। আখলাকের পরিবারের আইনজীবী মহম্মদ ইউসুফ সাইফি গণশক্তিকে জানান, সরকার যা করার চেষ্টা করুক, আদালতের উপরে আমাদের ভরসা আছে। আদালত এদিন দ্রুততার সঙ্গে মামলার শুনানির কথা বলেছেন। আমাদের বিশ্বাস, আদালত আমাদের ন্যায়বিচার দেবে। সব অপরাধীর শাস্তি হবে।
Mob Lynching Md Akhlaq
পিটিয়ে হত্যায় অভিযুক্তদের ছাড় নয়, প্রতিদিন শুনানি
×
Comments :0