STORY / DEBASHI ACHARJI / TAMANNA / MUKTADHARA / 10 AUGHST 2025 / 3rd YEAR

গল্প / দেবাশিস আচার্য / একটি মেয়ের গল্প তোমায় শোনাই শোনো / মুক্তধারা / ১০ আগস্ট ২০২৫, বর্ষ ৩

সাহিত্যের পাতা

STORY  DEBASHI ACHARJI  TAMANNA  MUKTADHARA  10 AUGHST 2025  3rd YEAR

গল্প / মুক্তধারা , বর্ষ ৩

একটি মেয়ের গল্প তোমায় শোনাই শোনো  

দেবাশিস আচার্য

কোনো এক গাঁয়ের মেয়ের গল্প তোমায় শোনায় শোনো।
জীবনের কুসুম ছেঁড়ার কাহিনী। উপকথা নয় সে নয়।
গল্প টা হয়তো আটপৌরেই থাকতো। একটা ঘটনা গল্পটাকে ওলটপালট করে দিলো।
ছোট্ট মেয়েটা সাজতে ভালবাসতো খুব। লাল রঙ ছিল সবচেয়ে প্রিয়। লাল রঙের সালোয়ার, লাল রঙের চুল বাঁধার ক্লিপ সঙ্গে লাল টকটকে লিপস্টিক ঠোঁটে লাগিয়ে বাড়ির আলমারির আয়নাতে বারবার নিজেকে দেখতো।মা বাবা তো মেয়ের কান্ড দেখে হেসেই খুন। মা মেয়েকে আদর করে বেটা বলে ডাকতো, আর বাবা বলতো তুই ই আমার মা।
বাবা কাজ করতেন বিদেশ বিভুঁইয়ে। তার ইচ্ছে করতো না এই মিষ্টি মেয়েকে ছেড়ে দূরে যেতে , তবুও কি আর করা যায়, নিজের রাজ্যে কাজ নেই, একশো দিনের কাজ ও বন্ধ। আবার যা মজুরি মেলে তাতে পড়াশোনা তো দুরের কথা ওষুধ কারেন্টের বিল চাল ডাল তেল নুন চিনি সব কিছুরই দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।আগে গাঁয়ের প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা হতো, যবে থেকে ইস্কুলের রঙ নীল সাদা হয়েছে, তবে থেকে পড়াশোনা লাটে, ইস্কুলে মাস্টার দিদিমনি নেই, হঠাৎ কয়েকজন মাস্টার এলো আবার চলেও গেল, টাকা দিয়ে নাকি মাস্টারির চাকরি কেনা হয়েছে। বাধ্য হয়ে পরিযায়ী শ্রমিক বাবা তার ছোট্ট আদরের মেয়েকে পলাশি বাজারের বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করেছে। এতো সব খরচ চালাতে তাই বাংলা ছেড়ে নিজের বাংলা ভাষায় কথা বলা লোক ছেড়ে বাবা ওড়িশায় কাজ করতে যায়।ও টিভিতে দেখেছে ওড়িশার সমুদ্র পারের আস্ত মন্দির এই রাজ্যের সমুদ্রের ধারে বানিয়েছেন মহারানী। মায়ের মনে হয় এর চেয়ে যদি রানী একটা ভিনরাজ্যের বড় কারখানা এখানে বানিয়ে দিতেন তবে তার মেয়ের বাবাকে ওদের ছেড়ে কাজে যেতে হতো না।

সামনের মাসের আঠাশ তারিখে ছোট্ট আদরের মেয়েটা দশ বছরে পা দেবে।এই গরীব ঘরে এমন গুনপনা চাঁদপারা মেয়ে কেন যে জন্মেছে কে জানে।সব সময় ফিটফাট হয়ে থাকে। পাড়ার অন্য বন্ধুরা নোংরা হয়ে থাকলে ও তাদের শাসন করে। নিজের হাতে কি সুন্দর ছবি আঁকে। খাতার পাতা থেকে ঘরের দেওয়ালে শুধু ছবি।গাছ ফুল পাখি প্রজাপতির ডানা মেলা ছবি ওর বেশি প্রিয়। রঙিন কাগজ দিয়ে ফুল পাখি প্রজাপতি গাছ ফুলদানি মালা তৈরি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয় ছোট্ট মেয়েটা। এবার ঈদে নিজের হাতে তৈরি শুভেচ্ছার কার্ড খামে ভরে বন্ধু থেকে আত্মীয় স্বজনদের দিয়েছে।
রাত জেগে এইসব হাতের কাজ করতো মেয়েটা। আবার পড়াশোনাতেও ভালো। অর্ণব স্যার তো সেজন্য ওকে খুব ভালো বাসতেন। ফটাফট ইংরেজি তে কথা বলতে দেখে মা বাবার সে কি হাসি। বাবা কে বলতো তুমি ইংরেজি টা শিখে নাও আমার কাছে, বাইরে গিয়ে অসুবিধা হবে না তোমার।
ছোট্ট মেয়েটার স্বপ্ন ছিল বড় ডাক্তার আর পুলিশ হবে। ডাক্তার হলে গরীব মানুষদের রোগ সারাতে পারবে। ওদের ছোট্ট গ্রামে কোনো বড় ডাক্তার নেই, রাত বিরাতে শরীর খারাপ করলে খুব কষ্ট হয়।আর পুলিশ মানে দুষ্টু লোকদের ধরতে পারবে।
ছোট্ট মেয়েটার শখ এবারে তার জন্মদিনে অনেক অনেক বন্ধুদের, অর্ণব স্যার,কলিম স্যার ইনজামুল স্যারকে নেমন্তন্ন করবে। সবাইকে তার মা পায়েশ রান্না করে খাওয়াবে, আব্বু অনেক বড় কেক এনে দেবে ‌। লাল রঙের বেলুন দিয়ে সাজাবে তাদের ছোট্ট বারান্দা। সকালে উঠে উঠোনে ফুলের গাছ লাগাবে।
ওর স্কুলের এক বন্ধুর জন্মদিনে ওর বড়লোক বাবা রক্ত দান শিবির করেছিল।ওর সেই ইচ্ছেটার কথাও মা আব্বুকে বলে ছোট্ট মেয়ে। বাবা বলেন, এবার জন্মদিনে আর আসতে পারবো না রে মা, এই তো ভোটের জন্য আসতে হলো। ছোট্ট মেয়েটা ভোট ফোট বোঝে না, শুধু দেখেছে এবার কি সুন্দর শাড়ী পরে একটা মেয়ে হাত নাড়াতে নাড়াতে গাড়িতে করে হুস করে যাচ্ছে আর কত লোক তার পেছনে পেছনে মোটর সাইকেলে চড়ে ছুটছে বড় বড় পতাকা নিয়ে।

মেয়েটাদের বাড়ি গাঁয়ের একেবারে শেষে , বাঁশ বাগানের ধারে। সারাদিন মা আর মেয়ের খুনসুটি। নিজের মনে সেজে গুজে গান গেয়ে নাচ করতো প্রজাপতির মতো ওড়না হাতে জড়িয়ে ডানার মতো।ওর মুখস্থ ছিল, কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে....."মেয়ের কান্ড দেখে মায়ের খুব আনন্দ হতো। ভোট দিয়ে বাবা চলে গেল ওড়িশায়।যাবার সময় বাবার গলা জড়িয়ে চুমু খেয়ে কত আদর আর সাবধানে থাকার কপট আদেশ  ছোট্ট মায়ের।আর সাথে চুলের লাল ক্লিপ কিনে তাড়াতাড়ি ফিরে আসার আকুতি ।
গ্রামের  পথ ছাড়িয়ে দৃষ্টি পথের আড়ালে চলে যায় বাবার টোটো পলাশি স্টেশনের উদ্দেশ্যে‌।
দুদিন পর সকাল থেকে ঝির ঝির করে বৃষ্টি।মেয়ের বায়না মায়ের কাছে, বৃষ্টিতে ভিজে ফুল গাছ লাগাবে উঠোনে। আসলে এই এক শখ, নানা রঙের ওর হাতে লাগানো ফুলের গাছে আসতে আসতে ছোট্ট উঠোনটাই ফুলের বাগান হয়ে গেছে।আর সেই ফুলের বাগানে লাল ফ্রক পড়ে মেয়েটা গাছ লাগাতো তখন মার  মনে হতো একটা লাল ফুল বা লাল রঙের প্রজাপতি গাছের ডালে ডালে উড়ে বেড়াচ্ছে।
মেয়ের কোন আবদার ই মা ফেলতে পারে না। আসলে মেয়েটা কোন দিন কোন দুষ্টুমি করে না , ফলে গায়ে হাত তুলতে বা বকতে হয়নি কখনো।তাই বৃষ্টির মধ্যেও উঠোনে নেমে মা মেয়ে গাছ লাগাতে থাকে। লাল রঙের বোতাম ফুলের গাছ।
এখনো সেই গাছটা রয়েছে বাড়ির উঠানে। শুধু মেয়েটাই নেই। সেদিন  রানীর যুদ্ধ জয়ের আনন্দে হঠাৎ  রানীর পোষা চব্বিশটা দৈত্য লোহা আর বারুদের আগুনে মেয়েটাকে একটা পোড়া মাংস করে দিল। ফিরে এলো বাবা।কত লোক।টি ভি তে ছবি। ডাক্তার পুলিশ। দৈত্য দানোর দল এখনও বেশিরভাগ অধরা। ওরা নাকি দেশের রানীর লোক। যুদ্ধ জয় করে ওই ছোট্ট মেয়েটা যে গান ফুল গাছ পাখি আর প্রজাপতি ছাড়া কিছুই জানে না, তাকে ফুলের বাগানে রক্ত আর মাংস করে দিল মহারানীর লোকেরাই।এ কেমন রানী বোঝে না মা । রানীর নাম আছে, টাকা আছে, মন্দির আছে, মেয়েটার মায়ের মতো হিজাব ও আছে, আছে প্রচুর পুলিশ,গায়ক নায়ক।রানী গান করেন, ছবি আঁকেন। শুধু রানীর নেই একটুও মমতা।
মেয়েটা এখন শুয়ে আছে মাটির নীচে। ওপরে এক সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পড়া বুড়ো লোক একটা নয়নতারা গাছ লাগিয়ে দিয়েছেন। মায়ের হাতে হাত রেখে ঝাপসা হয়ে গেছে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা ‌।
আজ মেয়েটার জন্মদিন‌।ওর বাবার মতো যারা অন্য রাজ্যে কাজে গেছে, নিজের দেশে কাজ না পেয়ে তাদের দলবল জন্মদিনে পায়েস রেঁধেছে। মেয়েটার গাছ লাগানোর ছবি এঁকেছে ছোট্ট ছোট্ট ছেলে মেয়েরা। সেগুলো টাঙানো হয়েছে দেওয়াল জুড়ে। রক্তদান শিবির হয়েছে।
চোখের জল মুছে মা আর আব্বু সেই পায়েসের বাটি তুলে দিয়েছে ছোট্ট ছোট্ট ছেলে মেয়েদের হাতে।আজ সারাদিন ওদের মধ্যেও খুঁজে পেয়েছে তাদের হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট মেয়েকে।এক প্রবীণ প্রতিবাদী চিত্রকর মেয়েটার ঘরের দেওয়ালে এঁকে গেছেন আলোর দেশে চাঁদের মতো মেয়েটির ভেসে যাওয়ার ছবি।
আর তারপর সন্ধ্যা নেমেছে মোলান্দিতে।নিকষ কালো বাঁশ বাগানের মাথার উপর এক চিলতে আকাশ। তার নীচে সেই বাগানের  রক্ত ভেজা মাটিতে লাগানো হয়েছে একটা কামিনী ফুলের গাছ। এক ভবঘুরে অনাত্মীয় আপনজন চোখ এর জল মুছতে মুছতে গাছটার নাম রেখে গেছে তামান্না।
আমার গল্পটি ফুরোলো না, রক্ত ভেজা মাটিতে মহামহিম রানীর ডাকিনী যোগিনী কতশত নাগিনী আর দৈত্য পুরীর লুটিয়ে পড়ার শেষ কথা লেখার অপেক্ষায় থাকলো।  নটে গাছটি মুড়িয়ে যায়, গল্পটা তো ফুরাই না ফুরাই না......

Comments :0

Login to leave a comment