ভাগ্যবান
সৌরীশ মিশ্র
"বাপি, তুমি জ্যোতি বসুকে দেখেছো?"
রবিবারের সন্ধ্যা। শ্রাবণ মাস চলছে। অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে ক'দিন ধরেই। এখনও মুষলধারাতেই চলছে বৃষ্টি। ললিতবাবু টিভি দেখছিলেন আয়েশ করে তাঁর বাড়ির ড্রইং-রুমের সোফায় বসে। একটা বাংলা নিউজ চ্যানেল দেখছিলেন তিনি। আর সেখানেই একটা খবরের সূত্রে দেখাচ্ছিল জ্যোতি বসুর একটা সাক্ষাৎকারের ক্লিপিংস। ঠিক তখুনি, ঐ ঘরে এসে ঢুকেছিল ললিতবাবুর পঞ্চদশী কন্যা লাবণ্য। আর, ঘরে পা দিয়েই টেলিভিশনের পর্দায় জ্যোতি বসুকে দেখে সোফায় ললিতবাবুর পাশে বসতে বসতে তার বাবাকে প্রশ্নটা করল সে।
টিভির পর্দা থেকে চোখ সড়িয়ে মেয়ের দিকে তাকান ললিতবাবু। তারপর বলেন, "হ্যাঁরে দেখেছি। একবার নয়, বেশ কয়েকবার।"
"তাই নাকি, বাপি! কখন দেখলে, কোথায় দেখলে, বলো না গো।"
"শুনবি?"
"হ্যাঁ, বলো না বাপি, শুনি।"
ললিতবাবুর মেয়ের আগ্রহ দেখে ভাল লাগে। তিনি রিমোট দিয়ে টিভিটা বন্ধ করে, মেয়ের দিকে তাকালেন সোজা। তারপর বলতে শুরু করলেন, "শোন তবে। সেটা ঊনিশশো আশির শেষ কিংবা ঊনিশশো নব্বই-এর শুরুর সময় হবে। আমরা তখন সল্টলেকে থাকি। বাবার চাকরিসূত্রে, একটা সরকারি আবাসনে। আমি তখন স্কুল-ছাত্র। প্রাইমারি বিভাগেই পড়ি। তা, আমি যে সরকারি স্কুলটায় পড়তাম তার খুব কাছেই থাকতেন জ্যোতিবাবু, ইন্দিরা ভবনে..."
"বাপি, সল্টলেকের সেই বাড়িটা, যেটা আগের বছর সল্টলেকে যখন গিয়েছিলাম আমি আর তুমি, তুমি দেখালে। উঁচু পাঁচিল। ঐটা?" ললিতবাবুর কথার মাঝেই ঢুকে কথাগুলো বলে লাবণ্য।
"হ্যাঁরে, ঐটাই। এক্কেবারে ঠিক বলেছিস। যাই হোক, যা বলছিলাম।" আবার জ্যোতি বসুকে দেখার গল্প বলতে শুরু করেন ললিতবাবু। "বাবা তো আমাকে স্কুলে পৌঁছেও দিতো, আবার স্কুল ছুটি হলে নিয়েও যেত বাড়ি, তা আমি যখন স্কুল থেকে ফিরতাম, বাবার সাইকেলে, প্রায়ই দেখতাম, জ্যোতিবাবু বাড়ি থেকে বেড়িয়ে, যাচ্ছেন কোথাও। এখন বুঝি, খুব সম্ভবত তখন রাইটার্সে যেতেন তিনি। কয়েকটা গাড়ির একটা কনভয় থাকতো। সাদা রঙের একটা অ্যাম্বাসাডর গাড়ি চড়তেন। ড্রাইভারের পিছনের সিটে বসতেন। আজও চোখের সামনে ভাসে রে ঐ দৃশ্য!" এইটুকু বলেই চুপ করে যান ললিতবাবু। কয়েকক্ষণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করে ঘরে। প্রায় মিনিট খানেক যায় এভাবেই। তারপর, লাবণ্যই বলে ওঠে প্রথম। "বাপি, তুমি খুব লাকি। জ্যোতি বসুকে দেখেছো।"
তখনও, শৈশবে জ্যোতিবাবুকে দেখার স্মৃতিতে ডুবে ছিলেন ললিতবাবু। মেয়ের কণ্ঠস্বরে যেন সম্বিৎ ফিরল তাঁর। তাই লাবণ্যকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, "কিছু বললি আমায়?"
"হ্যাঁ। বলছিলাম, তুমি ভীষণ লাকি, জ্যোতি বসুকে দেখেছো।"
মেয়ের কথা শুনে একটু হাসেন ললিতবাবু। মনে মনে ভাবেন, মেয়ে একেবারে ঠিক কথা বলেছে। এ কথা বিশ্বাস করেন তিনিও। এমন একজন কিংবদন্তীকে স্বচক্ষে দেখার, তাও মাত্র কয়েক হাত দূর থেকে, সত্যিই সৌভাগ্য না হলে হয় না। সত্যিই তিনি ভাগ্যবান।
Comments :0