নতুনপাতা
গল্প
স্কুল
তপন গোস্বামী
এখন বিকেল।সূর্য এখনও সন্ধ্যার কোলে ঝুঁকে পড়েনি।তাই স্পষ্ট দেখা যায় টুকটুক করে লক্ষ্মণ আসছে।ওকে দেখে ঘড়ি মিলিয়ে নেয় পাশের বাড়ির বলাই।পৌনে চারটে।লক্ষণ এসে কিছুক্ষণ বসে সিমেন্টে বাঁধানো পুরানো চাতালটায়।তারপর হাতা গুটিয়ে পুরনো ঘড়িটাকে চোখের সামনে নিয়ে আসে।চারটে বাজতে পাঁচ।সময় হল।এবার বেশ জোরে জোরে এক থেকে ষাট পর্যন্ত পাঁচবার গোনে।তারপর শক্ত পায়ে একটা গাছের তলায় এগিয়ে যায়।হাতটা ঘন্টা বাজাবার মতো করে ঘোরায়, কিন্তু ঘন্টাও থাকে না, হাতে বাজাবার ডান্ডাও থাকে না।মুখে কেবল গোঁ গোঁ শব্দ করে।চোখ বন্ধ।কিছুক্ষণ চুপচাপ।মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে লক্ষ্মণ।তারপর ধীরে ধীরে চাতালে গিয়ে বসে।অন্ধকার ঘন হয়ে আসে।লক্ষ্মণের মনে হয় তাকে ঘিরে বসে আছে একরাশ মানুষের ছায়া, যারা কেউ কেউ হয়ত আজ আর নেই।একদিন এরা সব এই স্কুলকে গমগম করে রাখতো।
এই এলাকার যারা বয়স্ক লোক তারা জানেন,আজ থেকে কুড়ি পঁচিশ বছর আগেও এখানে একটা প্রাইমারি স্কুল ছিল।কিছু ছাত্রছাত্রী ও গুটিকয়েক শিক্ষকও ছিলেন।ছিলেন এক হেডমাস্টার।সবাই অভাবী ঘরের মানুষ, জামাকাপড়েই তার ছাপ থাকত।তাই অভাবী ছেলেমেয়ের এই স্কুলে তারা বড় মানানসই ছিলেন।আর ছিল লক্ষ্মণ,স্কুলের একমাত্র চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, সর্বঘটে কাঁঠালি কলা।আলপিন থেকে চক ডাস্টার,সবাই লক্ষণকে ডাকে।লক্ষণ তো কাজকে কোনদিন ভয় পেতো না,তার বরং ভালোই লাগত।রবিবারের জন্য সবাই অপেক্ষা করতো,কিন্তু লক্ষ্মণের ছুটি ভাল লাগত না।সে ছুটির দিনেও স্কুলের এই চাতালে এসে বসে থাকতো।চারদিকে ঝাটপাট দিতে।
ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ক্রমশই কমছিল।ছাত্রী তো প্রায় ছিল না, ছাত্রও দিন দিন কমে আসতে লাগলো।এক তো কাছাকাছি দুটো বড়ো স্কুল ছিল,তাদের চাকচিক্য ছিল অনেক বেশি।তার ওপর এই স্কুলটির পাশেই ছিল বড়ো এক নদী।বর্ষাকালে ফুলে ফেঁপে এই নদীর তখন অন্য রূপ।প্রায় প্রত্যেক বছরই বর্ষায় বন্যা হয়ে যেত।তাই তখন স্কুল কিছুদিন বন্ধ রাখতে হত।হয়তো এই কারণেই ছাত্রছাত্রীদের টান কমছিল স্কুলের প্রতি।তারপর সরকারই একদিন স্কুলটা তুলে দিল।দু'একজন মধ্যবয়সী শিক্ষককে বদলি করা হল অন্য স্কুলে।আর হেডমাস্টার ও লক্ষ্মণের বয়স হয়ে গিয়েছিল বলে তাদের বসিয়ে দেওয়া হল।
তারপর লক্ষ্মণের চোখের সামনে ধীরে ধীরে শ্মশান হয়ে গেল এই স্কুল।প্রথমদিকে হেডমাস্টারমশাই আসতেন,দু-একজন প্রাক্তন ছাত্রও আসতো।লক্ষ্মণের সঙ্গে বাইরের চাতালে বসে থাকতো তারা,স্কুলটার গায়ে হাত বোলাতো।তারপর একসময় তারা আসা বন্ধ করলো।কিন্তু লক্ষ্মণের কেমন অভ্যাস হয়ে গেল।সারাদিন এখানে বসে থাকতো, সন্ধ্যা নামলে তবে বাড়ি ফিরতো।এখন ছেলেরা বড়ো হয়েছে।সারাদিন বসে থাকা নিয়ে বাড়িতে অশান্তি শুরু হল।পরে দিনে কেবলমাত্র একবার এখানে আসার অনুমতি পেল লক্ষ্মণ।ঘরগুলো তারই চোখের সামনে একে একে ভেঙে পড়লো।এখন একটা খণ্ডহর।শোনা যাচ্ছে হরেন প্রোমোটারের হাতে পড়ল বলে।
নানা জন নানা কথা বলে।তবে কোন কিছুই লক্ষ্মণকে স্পর্শ করে না।এই স্কুল যে তার কী,তা অন্যদের কী করে বোঝাবে!সে তো স্কুলের সঙ্গে কথা বলে।তাই সারা দুপুর সে ছটফট করে।দুপুর গড়িয়ে এলেই লক্ষ্মণ স্কুলের দিকে হাঁটতে শুরু করে প্রায় ভূতগ্রস্থের মতো।সে ঘন্টা না বাজালে ছেলেদের যে ছুটি হবে না!
Comments :0