দীপশুভ্র সান্যাল: জলপাইগুড়ি
ডুয়ার্সের জয়ন্তীতে সম্ভবত এবারই শেষ দুর্গাপুজো।
বক্সা টাইগার রিজার্ভের অন্তর্গত যত ফরেস্ট ভিলেজ আছে, সেগুলোর বাসিন্দাদের সরিয়ে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বন দপ্তর। ইতিমধ্যেই গাঙ্গুটিয়া ও ভুটিয়া বস্তির মানুষদের কালচিনি অঞ্চলে নতুন জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
আদালতের নির্দেশ দেখিয়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে মানব বসতি ধীরে ধীরে সরানোর লক্ষ্য জানিয়েছে বন দপ্তর।
‘ডুয়ার্স কুইন’ জয়ন্তীর দুর্গাপূজা শুরু হয়েছিল ১৯৪২ সালে সুলতা নরেশ রায়ের উদ্যোগে। সে সময় ডলোমাইট, কাঠ ও রেল ব্যবসার সুবর্ণযুগে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মিলনক্ষেত্র ছিল জয়ন্তী। পাহাড়, নদী আর জঙ্গলের কোলে গড়ে ওঠা গ্রামটির পুজো এখনো অনুষ্ঠিত হয় জয়ন্তী হাই স্কুলের স্থায়ী মণ্ডপে, মিলনি সংঘের আয়োজনে।
এই উৎসবে আশেপাশের সান্তালা বাড়ি, বক্সা, আদমা, লেপচা খা-সহ পাহাড়ি গ্রাম থেকে লেপচা, ভুটিয়া, নেপালি, আদিবাসী সহ সবাই ভিড় জমান। এমনকি এসএসবি ক্যাম্পের জওয়ান ও বন দপ্তরের কর্মীরাও অংশ নেন। পর্যটকেরাও শুধু ভ্রমণ নয়, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেন, অনেকে বিচারকের ভূমিকাও পালন করেন।
এবার বিদায়ের আবহ। রাতে হাতির আনাগোনা, বিদ্যুতের ঘাটতি বা লো-ভোল্টেজ— সব কিছুর মাঝেও কটেজের ব্যালকনিতে বসে পাহাড়-নদী-জঙ্গলের একসঙ্গে রূপ উপভোগ করাই পর্যটকদের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ।
স্থানীয় বাসিন্দারা অবশ্য আশাবাদী। তাঁদের বিশ্বাস, আগামী বছরও এখানেই দুর্গোৎসব হবে। আর যদি পুনর্বাসন হয়, তবে নতুন বসতিতেই এই ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন তাঁরা।
ডুয়ার্সের ইতিহাসের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে ভুটানের নাম। একসময় ভুটানের অধীনে ছিল ডুয়ার্স। ১৮৬৫ সালের “সিনচুলা চুক্তি”-র মাধ্যমে এই এলাকা ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। আলিপুরদুয়ারকে বলা হত “ডুয়ার্সের প্রবেশদ্বার”— এখান থেকেই ভুটানে যাতায়াত হতো। সেই ঐতিহ্যের ছাপ আজও রয়ে গেছে জয়গাঁও-ফুনশোলিং সীমান্তের কোলাহলে। দুর্গোৎসবের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনেও তার প্রতিফলন দেখা যায়।
ডুয়ার্সের বিভিন্ন জায়গায় দুর্গোৎসব মানেই আলাদা আবহ। আলিপুরদুয়ার শহরে একাধিক বড় পুজো হয়, যেগুলো আলোকসজ্জা ও থিমের জন্য বিখ্যাত। বীরপাড়ায় পুজো হয় চা-বাগান ঘিরে, যেখানে চা-শ্রমিক থেকে স্থানীয় বাসিন্দা সবাই মেতে ওঠেন উৎসবে। মাদারিহাট ও কালচিনির পুজো পাহাড়ি মানুষ ও সমতলের মিলনমেলা তৈরি করে।
বন দপ্তরের তরফে জানানো হয়েছে, পুনর্বাসিত পরিবারগুলিকে শুধু আর্থিক সহায়তাই নয়, নতুন জায়গায় বসতি গড়ার জন্য জমি ও পরিকাঠামোও দেওয়া হবে। দপ্তরের দাবি, এতে বনাঞ্চল সুরক্ষিত হবে এবং বাসিন্দাদের জীবনযাত্রাও উন্নত হবে।
অন্যদিকে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন অংশ বলছে, জয়ন্তীর মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গন্তব্য যদি রাতের জন্য বন্ধ হয়ে যায়, তবে ডুয়ার্সের পর্যটনে বড় ধাক্কা আসবে। তাঁদের মতে, সঠিক পরিকল্পনা করলে পরিবেশ রক্ষা ও পর্যটন উভয়ই সম্ভব ছিল।
Comments :0