প্রীতম ঘোষ, রাজু সরকার
উত্তরবঙ্গের চারটি জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেক অঞ্চল। এর মধ্যে অঞ্চলে ত্রাণ দিতে যায় ডিওয়াইএফআই। ডিওয়াইএফআই ৯অক্টোবর ছরতাণ্ডু গ্রামে এবং ১০ অক্টোবর সকালে ঝাড়কণ্ডা গ্রামে এবং গ্রাসমোর চা বাগানে ত্রাণ বিতরণ করে। উত্তরে মানুষের কাছে এখন খাদ্যের থেকেও বড় অভাব বস্ত্রের। খাবার দেওয়ার সময় লোকের লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিচ্ছিল। কিন্তু জামা কাপড় দেওয়ার সময় মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিনিয়ে নিচ্ছিল। এছাড়াও কিশোরী এবং যুবতী মহিলাদের প্রয়োজনীয় স্যানিটারি প্যাডেরও অভাব রয়েছে। এছাড়াও কিছু লোকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি যে, তারা ওই জমা জলের মধ্যে ছিল নিজেদের ঘরে। অনেকের ঘরে আছে ছোট ছোট বাচ্চা। তাদের নিয়ে বসেছিল বিছানার ওপরে। জল নামার পর তারা ঘর থেকে বেরোতে পারে। ততক্ষণে ভেসে গেছে গৃহপালিত মুরগি, গোরু, ছাগল। এমন অনেকের বাড়ি থেকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল লোকেদেরকেও। ভেঙে গেছে দোকান, বাড়ি, রাস্তাও। এছাড়াও লোকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে সেই সব অঞ্চলে পাচ্ছে না তারা আবাস যোজনা টাকা। এক মহিলা আমাদের জানান তাঁর স্বামীর পেটে ক্যানসার হয়েছে এবং তার মেয়ে পড়াশোনা ভালো হলেও তাঁকে আর পড়াতে পারছেন না। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের জহর নবোদয় বিদ্যালয় তার মেয়েকে ভর্তি করার চেষ্টা করলেও করতে পারছেন না।
ডিওয়াইএফআই’র রাজ্য সম্পাদক ধ্রুবজ্যোতি সাহা ও রাজ্য সভাপতি অয়নাংশু সরকার সহ অনেক ডিওয়াইএফআই নেতা বিকাশ ঝা, সৈনিক সুর, সমীরণ ঘোষ, প্রমুখ ছিলেন এই প্রতিনিধি দলে। সংগঠনের জেলা কমিটির সদস্যরাও ছিলেন।
একই ছবি দার্জিলিঙেও।
গত ৪ অক্টোবরের প্রবল বৃষ্টিতে দার্জিলিঙ জেলার পাহাড়ি অঞ্চল ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাহাড়ের দূরবর্তী গ্রামাঞ্চল, চা বাগান লাইন এবং বনবস্তির অনেক ছোট ছোট গ্রামে ভয়ানক ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে। অসংখ্য মানুষের ঘরবাড়ি ভেঙে তছনছ, রাস্তাঘাট উড়িয়ে নিয়ে জীবিকা প্রায় থেমে গিয়েছে। এমনই এক প্রত্যন্ত গ্রাম মিরিক থেকে প্রায় ৮-১০ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের নিচে — শিয়োক চা বাগান। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট এই চা বাগান বস্তিতে প্রায় ৬০ থেকে ৭০টি পরিবার বাস করত। বস্তিটির পাশ দিয়ে একটি সরু ঝোরা নেমে গিয়েছে। সেই ঝোরা পেরিয়ে গ্রামে ঢোকার জন্য ছিল একটি ছোট্ট পুল বা ব্রিজ। এই ব্রিজটিই ছিল গ্রামের একমাত্র সংযোগপথ।
গত ৪ অক্টোবর রাত থেকেই প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ের উপরের দিক থেকে ঝোরার ধার বরাবর ভূমিধস নামতে থাকে। গাছপালা, মাটি, পাথর—সব মিলিয়ে সেই ধসের প্রবাহ এসে ব্রিজে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে জমা হতে থাকে । প্রবল জলের চাপে ব্রিজটি ধীরে ধীরে নড়তে শুরু করে। তখন গ্রামের উপরের দিকের কিছু মানুষ নিচের দিকের লোকজনকে সতর্ক করেন, এবং ঘরবাড়ি ছেড়ে উঁচু জায়গায় উঠে যেতে বলেন।
অন্ধকার রাত, প্রবল বর্ষণ, বিদ্যুৎ নেই— তবুও জীবন বাঁচানোর তাগিদে অনেক পরিবার শিশুসন্তান ও বৃদ্ধদের নিয়ে পাহাড়ের ওপর দিকে উঠতে থাকেন। রাত প্রায় দেড়টা থেকে দু’টার মধ্যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। ব্রিজটি আর বৃষ্টির তীব্র জলরাশি ও ধসের ভার সহ্য করতে না পেরে ভেঙে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে সেই জলোচ্ছ্বাস ও পাথরের ধাক্কায় গ্রামের নিচের দিকের প্রায় ২০-৩০টি বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলে।
এক রাতের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় গোটা পাড়াটি। ভেঙে যায় ঘরবাড়ি, নষ্ট হয় ফসল, ভেসে যায় গৃহস্থের জিনিসপত্র। অনেক পরিবার আজ গৃহহীন। বর্তমানে প্রায় ১০-১২টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয় কমিউনিটি হলে। তাঁদের কারও ঘর নেই, কারও কাপড়চোপড় নেই, বাচ্চাদের বইখাতা, স্কুল ইউনিফর্ম—সব কিছুই আজ শেষ।
এই ধরনের অনেক গ্রামের খবর এখনো রাজ্য প্রশাসন পায়নি, অনেক জায়গায় সরকারি সাহায্য পৌঁছায়নি। অথচ মানুষ দুঃসহ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন,খাদ্য, পানি, ওষুধ, কাপড়, আশ্রয়—সব কিছুর অভাবে।
এই পরিস্থিতিতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) দার্জিলিঙ জেলা কমিটি ত্রাণ ও সহায়তার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমাদের কমরেডরা সোনাদার চারটি গ্রাম, মিরিকের ১১টি গ্রাম, দুধিয়ার ৩টি গ্রাম—মোট প্রায় সাতশো ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা খাদ্যসামগ্রী, নতুন বস্ত্র, কম্বল, ত্রিপল, পানীয় জল, প্রয়োজনীয় ওষুধ পৌঁছে দিচ্ছেন দুর্গম পাহাড়ি গ্রামগুলোতে।
পাহাড়ের কমরেডরা প্রতিদিন বিপজ্জনক পথে হেঁটে প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছে মানুষের খোঁজখবর নিচ্ছেন, আর সমতলের কমরেডরা ত্রাণ সংগ্রহ করে সেইসব উপকরণ পাহাড়ে পৌঁছে দিচ্ছেন। পাশাপাশি, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে বসে তাঁদের সমস্যার কথা শুনছেন, ভবিষ্যতের নিরাপত্তা ও পুনর্গঠনের পথ নিয়ে আলোচনা করছেন।
এই সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দাবিগুলির সঙ্গে একাত্ম হয়ে সিপিআই (এম) দাবি করেছে— প্রথমত, অবিলম্বে দার্জিলিঙ ও উত্তরবঙ্গের এই ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধসকে জাতীয় বিপর্যয় হিসাবে ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যেসব পরিবার গৃহহীন হয়েছেন, তাঁদের সুরক্ষিত স্থানে স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত, পাহাড় ও বনাঞ্চলে প্রাকৃতিক সম্পদের নির্বিচার লুট ও পরিবেশ ধ্বংস বন্ধ করতে হবে। চতুর্থত, খেলা, মেলা, পুজো ও কার্নিভালের নামে সরকারি অর্থ অপচয় বন্ধ করো— যখন মানুষ দুর্যোগে বিপর্যস্ত, তখন প্রতিটি টাকাই মানুষের জীবনের প্রয়োজনে ব্যয় করতে হবে। পঞ্চমত, রাজ্য সরকারকে এই পরিস্থিতিতে অধিক মানবিক ও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে — শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
Comments :0