রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ গ্রাস করছে রাষ্ট্রকে। স্বয়ংসেবক নরেন্দ্র মোদীর শাসন পেরিয়েছে এগারো বছর। কিন্তু ৯ লক্ষাধিক মহিলা সুযোগ পেয়ে সঙ্ঘকে বুঝিয়ে ছেড়েছেন যে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বামপন্থীদের দাবি।
মহিলাদের ‘গর্ভ সংস্কার’-এ বিশ্বাসী সঙ্ঘ তাদের শতবর্ষের রিপোর্টে তাই জায়গা দিতে বাধ্য হয়েছে নারীদের সমানাধিকারের দাবি, কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের অধিকারের প্রসঙ্গকেও। পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস’র এক উঁচু স্তরের নেতা মেনে নিয়েছেন,‘‘কোনও সংগঠনের পক্ষে তার বহুদিনের আগের সব বোঝাপড়ায় স্থির থাকা সম্ভব নয়। আরএসএস একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। আমাদেরও নানা সময়ে পর্যালোচনা করতে হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য আরও বিস্তার, যা নিয়ে কমিউনিস্টদের খুব মাথা ব্যথা। যে দাবিগুলি মহিলাদের সঙ্গে আমাদের আলোচনায় উঠে এসেছে, এটা ঠিক তার কিছু নিয়ে বামপন্থীরা দীর্ঘদিন মিছিল, মিটিং করছেন। কিন্তু কারও তোলা কোনও দাবি তার সম্পত্তি হয়ে যায় না। তা আসলে সমাজের হয়ে ওঠে।’’
ঠিক যে দাবি বামপন্থীদের ছিল এবং আছে, তা দেশের দাবি হয়ে উঠেছে। অন্তত সঙ্ঘের সংস্পর্শে আসা মহিলারাই তা স্পষ্ট জানিয়েছেন। ছাপার অক্ষরে নিজেদের নথিতে তা স্বীকার করেছে মহাদেব সদাশিব গোলওয়ালকারের প্রবল হিন্দুত্ববাদী সংগঠন।
চলতি বছরে আরএসএস’র শতবর্ষ পূরণ হচ্ছে। আগামী অক্টোবরের গোড়ায়, দুর্গাপূজার দশমীর দিন শতবর্ষ পূর্তি সঙ্ঘের। সেই উপলক্ষে সঙ্ঘ দেশের ২৬টি রাজ্যে মহিলাদের সঙ্গে নানাভাবে, নানা কর্মসূচির মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়েছে বলে তারা দাবি করছে। তাদের আরও দাবি, দেশের প্রায় ৯ লক্ষ মহিলার সঙ্গে তারা যোগাযোগ করেছে। উপস্থিত মহিলাদের একাংশ সম্মেলনগুলিতে সঙ্ঘের নেতৃত্বের সামনে নিজেদের সমস্যাগুলি তুলে ধরেছেন। ‘মহিলা সমন্বয়— মহিলা সম্মেলন বিহঙ্গম দৃশ্য’ নামের ওই রিপোর্টে সেই সমস্যাগুলি তুলে ধরেছে আরএসএস। নিজেদের হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের ভিত্তিতে বেশ কিছু ‘সমাধান’-এর কথাও সেখানে উল্লেখ করেছে সঙ্ঘ।
মহিলারা সঙ্ঘের নেতৃত্বের সামনে যে সমস্যাগুলি তুলে ধরেছেন, তার নানা দিক আছে। তার মধ্যে আছে কাজ, মজুরির সমস্যা। মোদ্দা কথা, সঙ্ঘের নেতৃত্বের সামনে সঙ্ঘেরই সংস্পর্শে আসা মহিলারা দেশের অর্থনীতি, শ্রমনীতির সমালোচনা করেছেন। অর্থাৎ যে দেশে এগারো বছর এক স্বয়ংসেবক প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসভা জুড়ে স্ববংসেবকদের ছড়াছড়ি, সেই দেশে মহিলাদের আর্থিক স্বনির্ভরতা প্রবলভাবে অবহেলিত।
দেশে মহিলাদের কাজ, শ্রম, মজুরির মতো কী কী সমস্যার কথা উল্লিখিত হয়েছে? সঙ্ঘের হিন্দিতে লেখা সেই রিপোর্টে ‘রোজগার সম্বন্ধীয় সমস্যায়ে’ অংশে লেখা হয়েছে— প্রথমত, মহিলাদের উপার্জনের সুযোগ কম (‘রোজগার কে কম অবসর’), দ্বিতীয়ত, স্বনির্ভরতার প্রশিক্ষণের অভাব (‘স্বরোজগার প্রশিক্ষণ কী কমি’), তৃতীয়ত, কারিগরি প্রশিক্ষণের সুযোগ কম (‘কৌশল প্রশিক্ষণ কা অভাব’), চতুর্থত, স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির উৎপাদিত সামগ্রীর বিক্রির সমস্যা, বিপণনেরও সমস্যা (‘স্বয়ংসহায়তা সমূহকে উৎপাদোঁ কী বিক্রি কী সমস্যা, বিপণন মে সমস্যায়ে’) এবং পঞ্চমত, সমকাজে সমবেতন নেই (‘সমান বেতন কা অভাব’)। উল্লেখযোগ্য হলো, কেন্দ্রের মোদী সরকার তাদের বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে মহিলাদের জন্য তাদের বিভিন্ন ‘অবদান’-এর ঘোষণা করে। সংসদের দুই কক্ষেই সাংসদের নানা প্রশ্নের জবাবে মহিলাদের জন্য সরকারের নানা প্রকল্পের ‘সাফল্য’-এর বিস্তারিত দাবিও করেন মোদী সরকারের মন্ত্রীরা। কিন্তু শতবর্ষের গৌরবের প্রচারে উচ্ছ্বসিত সঙ্ঘের রিপোর্ট স্পষ্ট করছে, ‘মোদী কী গ্যারান্টি’তে মহিলাদের জীবনে কোনও সমাধান আনেনি।
২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি যে ইশ্তেহার প্রকাশ করেছিল তার নাম ছিল ‘মোদী কী গ্যারান্টি-২০২৪’। সেখানে ‘মোদী কী গ্যারান্টি ফর নারী শক্তি’ অংশে দাবি করা হয়েছিল যে, এক লক্ষ মহিলাকে ‘লাখপতি দিদি’ হবার জন্য ক্ষমতাসম্পন্ন করা হয়েছে। তাছাড়া মহিলাদের আয় বৃদ্ধির নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলেও সেই নথিতে দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু মহিলাদের আলোচনায় মোদীর সেই ‘গ্যারান্টি’গুলির কোনও খোঁজ মেলেনি সঙ্ঘের সভাগুলিতে।
সঙ্ঘ রিপোর্টে জানিয়েছে যে, ৫ লক্ষ ৭৫ হাজার ৭৪০ জন মহিলা তাদের বিভিন্ন আলোচনাসভা, বৈঠকে যোগ দিয়েছেন। ২৬টি রাজ্য এবং ৬টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে তারা সম্মেলন করেছে। সব মিলিয়ে ৪৭২টি মহিলা সম্মেলন (সঙ্ঘ ‘সম্মেলন’ই লিখেছে) করেছে। সর্বাধিক সম্মেলন হয়েছে উত্তর প্রদেশে— ৬৪টি। যোগী-শাসনের সেই রাজ্যে ১ লক্ষ ৩৮হাজার ৯৮৪ জন মহিলা সঙ্ঘের সম্মেলনগুলিতে উপস্থিত ছিলেন। তবে এই ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ হলো, যেখানে বিজেপি জোট সরকারে সেই বিহারে যত মহিলাকে সংগঠিত করতে পেরেছে সঙ্ঘ বিভিন্ন সভা, বৈঠকে তার থেকে বেশি মহিলা পশ্চিমবঙ্গে সঙ্ঘের সেই সভাগুলিতে এসে মতামত দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে ২১টি সম্মেলনে ৮২৫৫ জন মহিলা যোগ দিয়েছেন। বিহারে সম্মেলন তারা করতে পেরেছে মাত্র ৯টি। এসেছিলেন ৬১০০ মহিলা। মহিলাদের অংশগ্রহণে উত্তর প্রদেশের পরেই স্থান মধ্য প্রদেশের। তারপর আছে যথাক্রমে মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, কর্নাটক।
উপার্জন, মজুরি ছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক ক্ষেত্রে মহিলাদের অনেকগুলি সমস্যার কথা সঙ্ঘের সম্মেলনগুলিতে মহিলারা তুলে ধরেছেন। ‘সামাজিক ক্ষেত্র’র মধ্যেই নারীদের বিঘ্নিত নিরাপত্তার ছবি তুলে ধরা হয়েছে।
Comments :0