Bihar SIR

ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে বিহারের একই কেন্দ্রে প্রায় ৮০ হাজার ভোটারের নাম বাতিলের চেষ্টা বিজেপি’র

জাতীয়

বিহারের একটি নির্দিষ্ট বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটার তালিকা থেকে প্রায় ৮০ হাজার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের নাম মুছে দেওয়ার চেষ্টা করেছে বিজেপি। তাঁরা দেশের নাগরিক নন বলে দাবি করে, স্থানীয় বিজেপি নেতারা নির্বাচন কমিশনের কাছে লাগাতার আবেদনপত্র জমা দিয়েছে। রাজ্যজুড়ে নির্বাচন কমিশনের বিশেষ সার্বিক সংশোধনের (এসআইআর) সুযোগ নিয়ে, বিহারের পূর্ব চম্পারণ জেলার ঢাকা বিধানসভা কেন্দ্রে ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার এই জঘন্য চক্রান্ত চলছে। সম্প্রতি ‘রিপোর্টার্স কালেক্টিভ’-র তদন্তে ভোটার তালিকায় কারচুপি ও দুর্নীতির এমন বেনজির ঘটনার কথা উঠে এসেছে।
নেপাল সীমান্তবর্তী বিহারের পূর্ব চম্পারণ জেলার ঢাকা বিধানসভা কেন্দ্র রাজনৈতিক ভাবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ২০২০-র বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে আরজেডি’কে হারিয়ে বিজেপি প্রার্থী জয়ী হন। তবে জয়ের ব্যবধান ছিল মাত্র ১০,১১৪। নভেম্বরের বিধানসভা ভোটে এই কেন্দ্রে আবারও বিজেপি ও আরজেডি’র মধ্যে জোর টক্করের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এবারে বিজেপি’র তথাকথিত ‘হিন্দু ভোটে’ ভাগ বসাতে পারে জন সুরাজ পার্টি। এতে বিজেপি যথেষ্ঠ অস্বস্তিতে রয়েছে। নানা সমীক্ষা বলছে, আরজেডি’র কাছে এই কেন্দ্র এবারে খোয়াতে পারে বিজেপি। এই কেন্দ্র ধরে রাখতে, এবার ঘুরপথে প্রায় ৪০ শতাংশ ভোটার—  অর্থাৎ ৭৮,৩৮৪ জন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে বিজেপি।  
রাজ্যে এসআইআর চলার সময় যে তুমুল উত্তেজনা শুরু হয়, তার সুযোগ নিয়ে ভোটার তালিকায় কারচুপির এই বেনজির প্রক্রিয়া চলেছে। এসআইআর’র পর প্রকাশিত নতুন ভোটার তালিকায় ভুলভ্রান্তি সংশোধনের জন্য যে ১৩ দিনের সময় দেওয়া হয়, তার মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রে বিজেপি’র বুথ স্তরের কর্মী শিবকুমার চৌরাসিয়া প্রতিদিন অন্তত ১০ জনের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার আবেদন জানান। যে ১৩০ জন ভোটারের নাম তিনি বাতিল করার আবেদন জানিয়েছেন, তাঁরা সবাই মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। তবে এই আর্জি জানানোর সময় তিনি কোন কারণ দেখাননি। আবেদনপত্রে শুধু লিখেছেন—  যে ব্যক্তিদের নাম জমা দেওয়া হয়েছে তাঁদের নাগরিকত্ব সঠিক ভাবে যাচাই করা উচিত।  
এদিকে নতুন ভোটার তালিকা সংশোধনের শেষ দিন, অর্থাৎ ৩১ আগস্ট বিজেপি বিধায়ক পবন জয়সওয়ালের আপ্ত সহায়ক ধীরাজ কুমার ঢাকা কেন্দ্রের ইআরও’কে এক বিশেষ আবেদনপত্র দেন। তার সঙ্গে ৭৮,৩৮৪ জনের এক সুদীর্ঘ তালিকাও দেন। বিজেপি বিধায়কের সহায়ক নতুন ভোটার তালিকা থেকে এই সমস্ত ব্যক্তির নাম পত্রপাঠ মুছে ফেলার দাবি করেন! বাসস্থানের শংসাপত্র যাচাই না করেই নাকি এই প্রায় ৮০ হাজার ভোটারের নাম যোগ করা হয়েছে। পাশাপাশি, পাটনায় রাজ্যের মুখ্য নির্বাচন আধিকারিকের (সিইও) কাছে রাজ্য বিজেপি’র লেটার হেডে আরেকটি আবেদন করা হয়। তাতে দাবি করা হয়, ঢাকা কেন্দ্রের ভোটার তালিকায় নাম রয়েছে এমন ৭৮,৩৮৪ জন নাকি ভারতীয় নাগরিকই নন! 
রিপোর্টার্স কালেক্টিভের তদন্ত বলছে, কমিশনের কাছে যে প্রায় ৮০ হাজার ভোটারের নাম মুছে ফেলার আর্জি বিজেপি জানিয়েছে, তাঁরা সবাই মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। অর্থাৎ ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে হাজার হাজার মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে মুছে ফেলার জঘন্য চেষ্টা করেছে বিজেপি। 
এদিকে এই ঘটনায় এই কেন্দ্রের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা ছড়িয়েছে। পূর্ব চম্পারণের ফুলওয়ারিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রায় ৯০০ মানুষের নাম বিজেপি’র জমা দেওয়া তালিকায় রয়েছে। তাঁরা সবাই মুসলিম। বিজেপি তাঁদের সবাইকে ‘অ-ভারতীয়’ বলে দাগিয়েছে। এবারেও বিহারে বিজেপি জোট ক্ষমতায় এলে নাগরিকত্ব হারানোর আশঙ্কা করছেন গ্রামবাসীদের বড় অংশ। এই গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান ফিরোজ আলম আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছেন, কয়েক প্রজন্ম ধরে এই গ্রামের সমস্ত পরিবার সেখানে থাকছে। আগে কখনও এমন আশঙ্কার মুখোমুখি তাঁদের হতে হয়নি। পঞ্চায়েত প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হয়েও তাঁকে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে? প্রশ্ন তুলেছেন ফিরোজ। ফুলওয়ারিয়ার মতো চন্দনবরা গ্রামের প্রায় পাঁচ হাজার বাসিন্দারও ভোটাধিকার বিজেপি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। বিজেপি’র তৈরি তালিকায় নাম রয়েছে এমন অনেকেই কমিশনের নিযুক্ত বুথ লেভেল অফিসার (বিএলও), স্কুল শিক্ষক এবং সরকারি কর্মচারী।  
সম্প্রতি এই বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে, বিজেপি গোটা ব্যাপারটি আড়াল করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিজেপি বিধায়ক পবন জয়সওয়ালকে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোন উত্তর না দিয়ে উলটে হুমকি দিয়েছেন। এই নিয়ে সংবাদমাধ্যমের নানাবিধ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে জয়সওয়াল আবার পাল্টা অভিযোগ করেন, আরজেডি’র পক্ষ থেকে নাকি ৪০ হাজার ‘হিন্দু ভোটারের’ নাম মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। যদিও এই অভিযোগের কোন প্রমাণ মেলেনি। 
এই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনও সন্তোষজনক কোন তথ্য দিতে পারেনি। ঢাকার ইআরও এমন একটি আবেদন পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। তবে তা নিয়ে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ইআরও জানিয়েছেন, গণহারে ভোটাধিকার বাতিলের এই ধাঁচের কোন আর্জি গ্রহণ করা হবে না। বিজেপি নেতাদের তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও এই সংক্রান্ত বিষয়ে আবেদনকারীদের সঙ্গে তাঁর কী আলোচনা হয়েছে, তা নিয়ে পর্যাপ্ত তথ্য তিনি দিতে অস্বীকার করেছেন।  
মিথ্যা দাবি করে ভোটার তালিকায় কারচুপির চেষ্টা জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ৩১ নম্বর ধারায় শাস্তি যোগ্য অপরাধ। এই ক্ষেত্রে ঠিক এমনটা করা হয়েছে। ঢাকার বিধায়ক সহ রাজ্য বিজেপি’র শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন এফআইআর দায়ের করা উচিত। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে কোন আইনি ব্যবস্থা নেয়নি। এই ঘটনা সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের এক প্রাক্তন আধিকারিক জানিয়েছেন, ইআরও স্তরের কোন আধিকারিক চট করে এমন কোন ঘটনায় এফআইআর দায়ের করতে পারেন না। তার জন্য সাধারণত তাঁকে নয়াদিল্লির অনুমতি নিতে হয়। এক্ষেত্রেও সম্ভবত তাই করা হয়েছে। অর্থাৎ অনুমান করা যায়, দিল্লির কর্তাদের চাপেই এই ঘটনায় কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কমিশনের শীর্ষ আধিকারিকরা বিহারের এই ঘটনাকে ধামাচাপা দিচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

Comments :0

Login to leave a comment