অন্তর্বর্তী সরকারের মদতে বাংলাদেশে মৌলবাদী তাণ্ডব বেড়েই চলেছে। বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহের পর, শুক্রবার ভোর রাতে রংপুরের ঠাকুরগাঁওয়ে এক সুফি পীরের মাজারে বহিরাগত ইসলামি মৌলবাদীরা ভাঙচুর চালায়। এদিকে শনিবার প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট ও উদীচীতে হামলা ও ভাঙচুরের প্রতিবাদে চট্টগ্রামে এক সাংস্কৃতিক সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়। তবে মৌলবাদীরা হামলা করবে বলে আশঙ্কা করে, নিরাপত্তার অজুহাতে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন তা বাতিল করে দেয়।
শুক্রবার ভোর রাতে রংপুরের ঠাকুরগাঁওয়ে হজরত বাবা শাহ সত্যপীরের মাজারে মৌলবাদীরা হামলা ও ভাঙচুর চালায়। শনিবার সকালে স্থানীয় মানুষ ও ভক্তরা সেখানে গেলে বিষয়টি জানতে পারেন। মাজারটি বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি)-র ঠাকুরগাঁও সেক্টরের সদর দপ্তরের সামনেই অবস্থিত।
শনিবার সকালে স্থানীয় লোকজন দেখেন, শতাধিক বছর পুরানো এই মাজারের প্রধান ঘরের দরজা, জানালা সহ পাশের দুটি কবর ভাঙা। মাজারের ভক্ত আবদুল আলীম হোসেন বলেন, স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রায় সবাই ছোট থেকে মাজারটি দেখছেন। সেখানে এমন কিছু করা হয় না যাতে ইসলামি কট্টরপন্থীদের অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে। এরপরেও কারা মাজারে ভাঙচুর করল, তা তাঁদের বোধগম্য হচ্ছে না। মাজার কমিটির সভাপতি এনামুল হক বলেন, বছরের পর বছর শত শত ভক্ত এই মাজারে আসেন। মাজারের কাজকর্ম নিয়ে স্থানীয় স্তরে কখনই কারোর আপত্তি ছিল না। মাজার ভাঙচুরের পিছনে অন্য কোনও ষড়যন্ত্র কাজ করেছে। এ ঘটনায় মামলা দায়ের করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
মাজারে ভাঙচুরের খবর পেয়ে উপজেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ সহ স্থানীয় পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা খাইরুল ইসলাম বলেন, মাজার ভাঙচুরের ঘটনায় ইসলামি মৌলবাদীরা জড়িত বলেই সন্দেহ করা হচ্ছে। ঠাকুরগাঁও সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনির হোসেন বলেন, মাজার ভাঙচুর হলেও সেখানে কোনও চুরির ঘটনা ঘটেনি। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। এর থেকে আন্দাজ করা যায়, লুটপাট নয় বরং ভক্তদের সন্ত্রস্ত করা এবং তাঁদের বিশ্বাসে আঘাত দেওয়াই হামলাকারীদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।
গত দেড় বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের মদতে বাংলাদেশে মৌলবাদী ও অতি-দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি সক্রিয়তা বাড়িয়েছে। তার জেরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপসনালয়ের পাশাপাশি সুফি দরগা, পীর মাজারের ওপর আক্রমণ বেড়েছে। মাজারে ভাঙচুর বা আগুন লাগানোর ঘটনার পাশাপাশি, পরিকল্পিতভাবে পীরদের কবরের অবমাননায় উসকানি জুগিয়েছে নানা মৌলবাদী গোষ্ঠী। একই ধাঁচের হামলার শিকার বাউল ও ফকির সংস্কৃতি। গত দেড় বছরে একাধিক বাউল শিল্পীকে দলবদ্ধভাবে নিগ্রহ করা হয়েছে। দেশের নানা প্রান্তে অসংখ্য বাউল গানের অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। হামলার ভয়ে বেশ কিছু জায়গায় আয়োজকরা অনুষ্ঠান বাতিল করেছেন। প্রসঙ্গত, ইসলামি মৌলবাদীরা সুফি ধারার বিরোধী এবং দরগা-মাজারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, উরস প্রভৃতিকে অ-ইসলামি আখ্যা দিয়ে এদের উপরে ধারাবাহিক হামলা-হিংসা চালাচ্ছে।
ঠাকুরগাঁওয়ের মতো বৃহস্পতিবার ভোর রাতে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে সুপ্রাচীন শাহজাহান উদ্দিন আউলিয়ার মাজারে ভাঙচুর চালিয়ে গোবর ও মলমূত্র ছিটিয়েছে দুর্বৃত্তরা। শুক্রবার সকালে স্থানীয় লোকজন তা দেখতে পান। পুলিশকে জানানো হয়। এই নিয়ে কেউ অভিযোগ জানাননি বলে দায় এড়ায় পুলিশ। উল্লেখ্য, এই ময়মনসিংহেই গত ১৮ ডিসেম্বর ধর্ম অবমাননার ভুয়ো অভিযোগ করে গার্মেন্টস শ্রমিক দীপু দাসকে পিটিয়ে হত্যা করার পরে বিবস্ত্র করে গাছে ঝুলিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
ঠাকুরগাঁওয়ের মতো ময়মনসিংহের ঘটনাতেও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, তাঁদের বাবা-দাদারাও এই মাজার দেখে গেছেন। দুর্বৃত্তরা মাজারটি ভেঙে মল ছিটিয়েছে। এখানে কোনও গানবাজনা, ওরস হয় না। যাঁরা মানত দিতে আসেন, তাঁরা রান্নাবান্না করে মানুষদের খাইয়ে চলে যান। তাঁদের ধারণা, এলাকার কোনও লোক এ কাজ করেনি। বাইরে থেকে দুর্বৃত্তরা এসে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
এদিকে শনিবার মৌলবাদীদের চাপে বাংলাদেশে আরও এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিরাপত্তাজনিত কারণে বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন আয়োজকরা। গত সপ্তাহে ঢাকার ছায়ানট ও উদীচীতে উন্মত্ত দুষ্কৃতী বাহিনীর হামলার প্রতিবাদে, শনিবার বিকেল ৪টায় জেলা শিল্পকলা অ্যাকাডেমির প্রাঙ্গণে ‘গানে গানে সংহতি-সমাবেশ’-র আয়োজনের ঘোষণা করে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন। তবে ইসলামি মৌলবাদীদের থেকে আক্রমণের আশঙ্কা করে এই অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়।
আয়োজকেরা জানান, ছায়ানট, উদীচী সহ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, সংবাদপত্র, গণমাধ্যম, সাংবাদিক ও শিল্পীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে গান গেয়ে সংহতি জানানোর লক্ষ্যে এই আয়োজন করা হয়। ১০টি গান পরিবেশন এবং একটি বিবৃতি পাঠের মাধ্যমেই অনুষ্ঠানটি পরিকল্পনা করা হয়েছিল। আয়োজক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলির পক্ষে ‘জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ চট্টগ্রাম’ এক বিবৃতিতে জানায়, নিরাপত্তার অজুহাতে পুলিশ প্রশাসন অনুষ্ঠানটি বাতিল করতে বাধ্য করেছে। রাস্তার বদলে শিল্পকলার মাঠে করার প্রস্তাবও নিরাপত্তার কারণে নাকচ করে দেওয়া হয় এবং পুলিশের বিশেষ শাখায় আগাম পত্র দিয়ে অনুমতি নিয়ে পরে আয়োজনের পরামর্শ দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, শুক্রবার ফরিদপুরে দুষ্কৃতীদের হামলায় বাংলাদেশের প্রথিতযশা সঙ্গীতশিল্পী জেমসের অনুষ্ঠানও পণ্ড হয়। ফরিদপুর জেলা স্কুলের ১৮৫ বছরপূর্তির অনুষ্ঠানের শেষ দিনে বহিরাগতদের ইট নিক্ষেপের কারণে জেমসের অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে যায়। পুলিশের দাবি অনুষ্ঠানে জেমস আসবে শুনে বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক হাজার মানুষ সেখানে ভিড় করেন। তবে তাদের ঢুকতে দেওয়ায় উত্তেজনা ছড়ায়। অতএব স্কুল প্রাঙ্গণের বাইরে থেকেই তারা ইটবৃষ্টি শুরু করে। এতে জেমসের অনুষ্ঠান পণ্ড হয়। বহু ছাত্র-ছাত্রী আহত হন। আপাতদৃষ্টিতে এই ঘটনায় কোনও মৌলবাদী যোগ নেই বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক সমাবেশ বাতিলের কারণ হিসাবে এই অনুষ্ঠান পণ্ড হওয়ার ঘটনাটি পুলিশ প্রশাসন অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করেছে।
Bangladesh
বাংলাদেশে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুই মাজারে মৌলবাদী তাণ্ডব
×
Comments :0