তিন বছর আগে শ্রীলঙ্কা, গত বছর বাংলাদেশ এবার নেপালে প্রবল বিক্ষোভের মুখে পতন ঘটল নির্বাচিত সরকারের। শ্রীলঙ্কার বিক্ষোভে জনতাই ছিল রাস্তায়। বাংলাদেশে মূলত সামনে ছিল ছাত্ররা। আর নেপালের বিক্ষোভে ছাত্র-যুব তথা তরুণ সমাজই ছিল মূল শক্তি। তবে এর কোনটিই শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ছিল না। বাঙ্গলাদেশের মতোই হিংস্র, উন্মত্ত, অমানবিক ও ধ্বংসাত্মক চেহারা নেয় নেপালের বিক্ষোভ। বিক্ষোভকারীরা শুধু প্রতিবাদ-বিক্ষোভ, জমায়েত-অবরোধে ক্ষান্ত হয়নি। তারা বেপরোয়াভাবে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটও করেছে। থানা আক্রমণ করে পুলিশের অস্ত্র লুট করেছে। তারপর সেই অস্ত্রই ব্যবহার করেছে পুলিশ ও অন্যদের বিরুদ্ধে। সংসদ ভবন, রাষ্ট্রপতি ভবন, সুপ্রিম কোর্ট, প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি, সরকারের প্রধান কার্যালয় থেকে শুরু করে যেখানে যত সরকারি সম্পদ পেয়েছে, হয় ভেঙেছে, নয় পুড়িয়েছে। রাজনৈতিক দল ও নেতাদের বাড়ি, দপ্তর এবং ব্যক্তিগতভাবে হামলা-ভাঙচুর হয়েছে। পোড়ানো হয়েছে সংবাদমাধ্যমের দপ্তর। পুড়িয়ে মারা হয়েছে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীকে। এককথায় নৈরাজ্যের এক চরম অবস্থা দেখছে গোটা দুনিয়া। নিঃসন্দেহে ক্ষোভ, হতাশা, অবিশ্বাস এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে তরুণ প্রজন্ম এমন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে অমানবিক আচরণ করতেও দ্বিধা করেনি।
কেন এতটা ক্ষেপে উঠেছে তরুণরা? আপাত দৃষ্টিতে ২৬টি সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম সরকার বন্ধ করে দেবার প্রতিক্রিয়ায় তরুণরা বেপরোয়া হয়েছে বলে ধরা হলেও, এটা আসলে সমস্যার হিমশৈলের চূড়া মাত্র। যে দেশ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে রীতিমতো গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তৈরি করেছে, হিন্দু রাষ্ট্র থেকে ধর্মনিরপেক্ষ হয়েছে, সেদেশ দেড় দশক কাটতে না কাটতেই রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর আস্থা ও বিশ্বাস হারানোর মূলে রাজনৈতিক দল ও সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতা। একথা অনস্বীকার্য, রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ও ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে কমিউনিস্ট তথা বামপন্থীদের ভূমিকা ছিল সর্বাধিক। কিন্তু নতুন ব্যবস্থায় গত এক দশক ধরে সরকার গণতান্ত্রিক ভাবে সরকার পরিচালিত হলেও মানুষের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হয়নি। এই আন্দোলনগুলি জনগণের, বিশেষত যুবদের, ক্রমবর্ধমান অভিযোগের এবং হতাশার প্রতিফলন, যা বিগত সরকারগুলির তাদের প্রকৃত সমস্যা সমাধান করতে এবং আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে বারবার ব্যর্থতা থেকে উদ্ভূত বিস্তৃত ক্ষোভের প্রতিফলন। এই আন্দোলনে ২০ জন তরুণ প্রাণ হারিয়েছেন।
শাসক মহলে ব্যাপক দুর্নীতি, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এবং তরুণদের জন্য কাজের সুযোগের অভাব এই GenZ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কারণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ হওয়ার পর এই আন্দোলন বিস্ফোরিত হয়েছে। কেপি শর্মা ওলি সরকারের পতনের পর দেশে শান্তি ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনাই এখন সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ উদ্বেগজনক চেহারা নিচ্ছে। বিশেষভাবে নিন্দনীয় হলো প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ঝলনাথ খনালের স্ত্রী রাজলক্ষ্মী চিত্রকারের ওপর প্রাণঘাতী আক্রমণ, যিনি বর্তমানে আশঙ্কাজনক অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন।
নেপালের যুবসমাজের ক্ষোভ অবিলম্বে শোনা উচিত এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে তাদের সমস্যার সমাধান করতে হবে। একইসঙ্গে সংবিধানে বর্ণিত গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষতার মূল্যবোধকে রক্ষা করতে হবে — যা রাজতন্ত্রবিরোধী দীর্ঘ ও কঠিন সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। নেপালের যুবসমাজ ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে সজাগ থাকতে হবে, যাতে রাজতন্ত্রী ও অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে না পারে।
মন্তব্যসমূহ :0