ভাঙনের কবলে মালদহ ও মুর্শিদাবাদে বিস্তীর্ণ এলাকা। দুই জেলার গ্রামের পর গ্রাম গঙ্গার গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে, মানচিত্র থেকে মুছে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ জনপদ।
কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারই উদাসীন। ভাঙন মোকাবিলার নামে চলছে দুর্নীতিও। এই পরিস্থিতিতেই গঙ্গার ভাঙনকে জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণার দাবিতে, স্থায়ী ভাঙন রোধ ও পুনর্বাসনের দাবিতে মুর্শিদাবাদ ও মালদহ জেলা বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে হাজার হাজার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ফরাক্কা চলো’র ডাক দেওয়া হয়েছে। প্রস্তুতি তুঙ্গে। গঙ্গা ও পদ্মার ভাঙনের কবলে থাকা, সর্বস্ব হারানোর মানুষজন লাল ঝান্ডার ডাকেই শামিল হবেন বৃহস্পতিবার ‘ফরাক্কা চলো’ কর্মসূচিতে। উপস্থিত থাকবেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমও। দুপুর দু’টোয় দুই জেলার মানুষজন নিউ ফরাক্কা মোড় থেকে মিছিল করে ক্যানেল মোড়ে জমায়েত করবেন। সেখানে বিশাল সমাবেশ হবে। এরপর দুই জেলার প্রতিনিধিরা গিয়ে ফরাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষের কাছে দাবিসনদ পেশ করবেন।
মুর্শিদাবাদে পদ্মার ভাঙন ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছে। লালগোলার তারানগর, রাধাকৃষ্ণপুর, কালিনগরে ভাঙন একের পর বাড়ি গিলে খাচ্ছে। এখনও পর্যন্ত ২০টি বাড়ি জলের গর্ভে তলিয়ে গিয়েছে। অন্যত্র সরে গিয়েছেন গ্রামের বহু মানুষ। রাজ্য সরকার ভাঙন নিয়ে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ভাঙন দেখতে এসে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি লালগোলার বিধায়ক মহম্মদ আলি। ভাঙন বিধবস্ত মানুষের সঙ্গে রয়েছেন সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেস পরিচালিত লালগোলা পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ ও সদস্যরা। পঞ্চায়েত সমিতির ভূমি কর্মাধ্যক্ষ ইসমাইল শেখ জানিয়েছেন, ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। রাজ্য সরকারকে সকলের পুনর্বাসন, ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। মঙ্গলবার থেকে ভাঙনের মাত্রা বেড়েছে। নদী পাড়ের মানুষ বাড়ি ভেঙে নিয়ে ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছেন।
মঙ্গলবার গভীর রাত থেকে ভাঙন শুরু হয়েছে রঘুনাথগঞ্জ ২ ব্লকের শেখালিপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের রামকৃষ্ণপুর গ্রামে। ভাঙনে জমি তলিয়ে যাচ্ছে। তলিয়ে যাচ্ছে বাড়িও। বুধবার মাঝরাত থেকে প্রায় ১০টি বাড়ি পদ্মার গর্ভে তলিয়ে গিয়েছে। বাড়ি ছেড়ে স্থানীয় স্কুলে, আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন গ্রামবাসীরা। নিজের হাতে বাড়ি ভেঙে ফেলছেন গ্রামের মানুষ। সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ইট থেকে আসবাব। এদিন ভাঙন বিধ্বস্ত গ্রামে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কাজে হাত লাগান সিপিআই(এম) নেতারা। ছিলেন পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য সোমনাথ সিংহ রায়, পার্টি নেতা ওসমান গনি, মামলত হোসেনরা। গ্রামবাসীদের ক্ষোভ, ভাঙন নিয়ে প্রশাসনের কোনও হেলদোল নেই। ভাঙনের ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে স্থানীয় বিধায়ক, সাংসদ কারও দেখা মেলেনি। ভাঙনে সব হারানো পরিবারগুলির জন্য কোনও ত্রাণ শিবিরের ব্যবস্থাও নেই।
মালদহের বিস্তীর্ণ তল্লাট বরাবরই ভাঙন এলাকা বলেই পরিচিত। অবশ্য ২০১১ সাল থেকে কার্যত ভাঙন রোধে কোনও তৎপরতা নেই সরকারের। ১৯৮২ সাল থেকে এই এলাকাটি ফরাক্কা ব্যারেজ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়। বামফ্রন্ট সরকারের সময় একাধিক পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ভাঙন রোধে ব্যবস্থাও হয়। দীর্ঘ আন্দোলন, লড়াইয়ের পর ২০০৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্য হয় দাবি মানতে। ফরাক্কা ব্যারেজের উজানে ৮০ কিলোমিটার ও ডাউনে ৮০ কিলোমিটার— বিস্তীর্ণ এলাকার ভাঙন প্রতিরোধে ফরাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কমিটিও তৈরি হয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে ভাঙন মোকাবিলার কাজে। যদিও ২০১১ সালের পর থেকে সেই কাজ থমকে, কমিটির কোনও বৈঠকও হয় না। ভাঙন মোকাবিলা রাজ্য সরকারের যেন অগ্রাধিকারের তালিকাতেই ঢোকেনি ২০১১ সালের পর থেকে। একইসঙ্গে ভাঙন প্রতিরোধে বিপুল কাটমানি, দুর্নীতির অভিযোগও উঠতে শুরু করেছে। রহস্যজনকভাবে বর্ষাকালেই শুরু হয় ভাঙন মোকাবিলার কাজ, ফলে টাকা আসলে জলেই যায়। আবার ফরাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব নিলেও ব্যারেজের নিচের দিকের এলাকায়, ব্যারেজ থেকে পারলালপুর-ধুলিয়ান গঙ্গা খেয়াঘাট পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার এলাকায় ভাঙন চলছেই।
মালদহ ও সামসেরগঞ্জে নদী ভাঙন নিয়ে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের কোনও হেলদোল নেই। গঙ্গানদীর ভাঙ্গনের কবলে পড়ে মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের জীবন অতিবাহিত করা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। বিগত প্রায় পাঁচ দশক ধরে বিশেষ করে ফরাক্কা ব্যারেজ হওয়ার পরবর্তী সময় থেকে মালদহের বাঁ তীরে এবং মুর্শিদাবাদ জেলার ডান তীরে ব্যাপক ভূমিক্ষয় হচ্ছে। গঙ্গানদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে ভাঙনে মানুষের ভূমিহীন, বাস্তুহীন হওয়ার ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে। ঘরবাড়ি, কৃষিজমি, আমবাগান, হাট-বাজার, বিদ্যালয়-মাদ্রাসা, পোস্ট অফিস, মন্দির-মসজিদ নিশ্চিহ্ন হচ্ছে।
এদিকে, বন্যা ও ভাঙন প্রতিরোধের দাবিতে ফারাক্কা ব্যারেজ অভিযানকে সামনে রেখে বুধবারও জেলার দুই জেলা জুড়ে একাধিক সভা হয়েছে। মালদহের মানিকচক, কালিয়াচক-২ ও রতুয়া-২ ব্লকে মিছিল ও সভা অনুষ্ঠিত হয়। রতুয়া-২ ব্লকের সভা ও মিছিল হয় সম্বলপুর। নেতৃত্ব দেন পার্টির জেলা সম্পাদক কৌশিক মিশ্র, চৈতন্য মণ্ডল ও রেজাউল করিম। মানিকচক ব্লকের হিরানন্দপুরের কর্মসূচিতে ছিলেন দেবজ্যোতি সিনহা ও শ্যামল বসাক। কালিয়াচক-২ ব্লকের মিছিল ও পভা হয় সুলতানটোলা ও চেতারুটোলার মানুষদের নিয়ে। নেতৃত্ব দেন নৈমুদ্দিন নেই ও আসরাউল হক।
Ganga erosion
গঙ্গা ভাঙনকে জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণার দাবি, দু’জেলার বামফ্রন্টের ডাকে আজ ফরাক্কা ব্যারেজ অভিযান

×
Comments :0