অপরাজিত বন্দোপাধ্যায়
‘নেট জিরো’ নিয়ে আলোচনা জোরদার চলছে। অনেকের বিষয়টি জানা, অনেকের মনে আবার এ বিষয়ে রয়েছে প্রচুর প্রশ্ন। ‘নেট জিরো’র প্রকৃত উদ্দেশ্য বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসের ভারসাম্য রক্ষা। বাতাসে এক লিটারও গ্রিণ হাউস গ্যাস মিশবে না, তা হতে পারে না। বাতাসে   গ্রিন হাউস গ্যাস মিশলেও তা শুষে নেওয়ার ব্যবস্থা রাখলে ‘নেট জিরো’-কে ছোঁয়া যাবে।   জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে গ্রিন হাউস গ্যাসের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে গেলে গ্রিণ হাউস গ্যাস নির্গমনকে কমাতেই হবে। 
এ বিষয়ে সব বিশেষজ্ঞদের একটাই মত। জলবায়ু পরির্তন আমাদের পরিবেশ, প্রকৃতিকে বদলে ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তন এই বিরূপ প্রভাব শুধু ভারতে নয়, গোটা বিশ্বের দেশে এখন প্রকট হয়ে দেখা যাচ্ছে। আর এই পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন প্রান্তিক মানুষ। ২০২১ সালের নভেম্বরে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো’তে রাষ্ট্রসংঘের ২৬তম জলবায়ু সম্মেলনে প্রকৃতির ওই বিরূপ পরিবর্তন নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলেছে। সেখানে যোগদানকারী দেশের প্রধানরা বিশ্ব প্রকৃতির স্বাস্থ্য ফেরাতে নানান পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেন।
                        
                        
‘নেট জিরো’ এবং ভারত
জলবায়ু সম্মেলনে ভারতের তরফে প্রতিনিধিত্ব করা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেন,  ২০৭০ সালের মধ্যে ভারত ‘নেট জিরো’ লক্ষ্যমাত্রাকে অর্জন করবে। অত্যন্ত দূরবর্তী ওই লক্ষ্য সফল করার জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে ভারত নয়া পদক্ষেপ নেবে বলে সকলকে আশ্বস্ত করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারত সরকারের সেসব  অঙ্গীকার করেছে তা ২০২২ সালের আগস্ট মাসে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত রাষ্ট্রসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনে জমাও পড়েছে।
বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে ২০১৬ সালে প্যারিস চুক্তি হয়েছিলো। সেখানে বলা হয়েছিলো, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের সামগ্রিক গ্রিন হাউস নির্গমনকে ৪৫ শতাংশ কমাতে হবে। আর তা ঠিক মতো করা গেলে ২০৫০ সালের মধ্যে ভারত ‘নেট শূন্য’র লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়ার কথা। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫ এবং ২০২০ সালের মধ্যে ভারতে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন ৭ শতাংশ বেড়েছে। এর জন্য দায়ী সরকারের কিছু ভ্রান্ত নীতি। ভারত যেভাবে কয়লা থেকে শক্তি উৎপাদন চালিয়ে আসছে, তা গ্রিন হাউস গ্যাসকে কমানোর পক্ষে কোনও বিকল্প নয়।  
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝাপটা ভারতে
ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি’র সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হতে চলেছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এই দেশের মানুষের কাছে সবেচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট রিপোর্ট বলছে, ২০২২ সালের প্রথম নয় মাসে, ভারতের কোনও না কোনও প্রান্তে সাধারণ মানুষ চরম আবহাওয়ার সম্মুখীন হচ্ছেন। কখনো তাপপ্রবাহ তো কখনো শৈত্যপ্রবাহ, কখন বন্যাতো কখন ঘূর্ণিঝড় কিংবা ভূমি ধস। লাগাতার ওই সব ঘটনা ঘটতে থাকায় প্রকৃতির বিরূপতার সঙ্গে লড়াই করাটা অসম্ভব হয়ে উঠছে। এসবের মধ্যে ভারত সরকার ঘোষণা করেছে - দেশের প্রতিটি প্রত্যন্ত গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হবে। অথচ এখনো লক্ষ লক্ষ মানুষের বিদ্যুত ব্যবহারের কোন সংস্থান নেই। 
এখনো দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান জ্বালানি হয়ে থাকছে কয়লা। তাই এই চিন্তার গুণগত পরিবর্ত আনতে না পারলে গ্রিন হাউস গ্যাসের মাত্রাকে কমানো যাবে। দেশে বিপুল কয়লার ভান্ডার থাকলে এখন ভারত কয়লা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারেনি। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণের কয়লাকে আমদানি করতে হয়ে। কয়লা থেকে মানুষকে সরিয়ে নিতে সবচেয়ে বড় বাধা সেই সব মানুষকে অন্য পেশায় নিয়ে যাওয়া। ভারত সরকারের কয়লা প্রীতি কিছুতেই কমছে না।
                        
                        
বেশি ভরতুকি জীবাশ্ম জ্বালানিতে
হিসাব বলছে সবুজ শক্তি উৎসের তুলনায় ৪ গুণ বেশি ভর্তুকি এখন জীবাশ্ম জ্বালানি ক্ষেত্রে দিয়ে আসছে কেন্দ্র সরকার। জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, জীবাশ্ম গ্যাস, তেল) ক্ষেত্রে ২০১৪ থেকে ২০২২ অর্থবর্ষে মোট ৬০ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা যেখানে সরকারি ভর্তুকি দেওয়া হয়েছিলো, সেখানে পুর্নব্যবহারযোগ্য শক্তি ক্ষেত্রে দেওয়া হয়েছে মাত্র ১৩ হাজার  ৮৮৭ কোটি টাকা। দেশে কয়লার দাম একটানা ৪ বছর ধরে না বাড়লেও বার্ষিক ভর্তুকি ১৫ শতাংশ করে বাড়িয়ে গেছে কেন্দ্র। 
একটি নামী কোম্পানি বাতাসে যে পরিমাণ গ্রিন হাউস বাতাসে ছাড়ছে, তা সমপরিমান বাতাস থেকে শুষে নিতে লাগানো হচ্ছে প্রচুর গাছ। আর সেই গাছ লাগানোর কাজ যে ব্যক্তি বা কোম্পানি করবে, তাকে নিয়মিত টাকার অঙ্কে ‘কার্বন ক্রেডিট’ দিতে হবে। সব কিছুর পরেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা, তেল ও গ্যাস থেকে দূরে সরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত সরকার। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ মন্ত্রক পরামর্শ দিয়েছে ২৫ বছরের মধ্যে কয়লা উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। 
কেন্দ্র সরকার ঘোষণার পর ঘোষণা করে গেলেও তা বাস্তবায়িত করার জন্য ভারত সরকার কোন আইন প্রণয়ন করেনি। কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবর্তন করতে সুষ্ঠ শক্তি পরিবর্তন ঠিক কীভাবে ঘটানো যাবে তা নিয়ে কোন পরিকল্পনাও সামনে আসেনি। উলটে পশ্চিম বর্ধমানে ইস্টার্ন কোলফিল্ডের (ইসিএল) চালু খনিতে চলছে অত্যাধুনিক যন্ত্রে কয়লা উত্তোলন।
                        
                        
সর্বক্ষণ খনন প্রযুক্তি চালিয়ে ঝাঁঝড়া প্রজেক্ট কোলিয়ারিতে ২০২১-২২ অর্থবর্ষের ৩৩ লক্ষ টনের লক্ষ্যমাত্রাকে বাড়িয়ে ২০২২-২৩ আর্থিক বর্ষে তা ৫০ লক্ষ টন করার জন্য চলছে জোরদার কাজ। কাজে খামতি নেই এখানকার ২৬০০ স্থায়ী কর্মীর সঙ্গে ৩,৮০০ ঠিকা কর্মীর। অথচ সেখান থেকে একটু দূরে জামুড়িয়ার কুনুস্তরিয়া দিকে তাকালে দেখা যাবে সেখানে কী পরিণতি নেমে আসছে। খননে লাভ তেমন না হলে খনি মুখ খোলা রেখেই কাজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। 
খনির আশপাশে গড়ে ওঠা শ্রমিক বস্তির মানুষরা বিকল্প পেশার জন্য হন্যে হয়ে থাকেন। সরকারি সংস্থা রোজগারের কোন বিকল্প সুযোগ দেয় না। বন্ধ হয়ে যাওয়া তপসী কোলিয়ারিতে তাই শুধুই হতাশা। তাই শক্তির সুষ্ঠ পরিবর্তন আনতে গেলে বিকল্প পেশার বন্দোবস্ত করাটা সবচেয়ে জরুরী। 
সুষ্ঠ শক্তি পরিবর্তন
জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশন বা সুষ্ঠ শক্তি পরিবর্তন নিয়ে কিছু বলতে গেলেই সরকারি দপ্তরের একটাই কথা, এটা করতে গেলে প্রচুর টাকা লাগবে। কয়লা, গ্যাস, তেল থেকে দূরে সরে যাওয়াই সুষ্ঠ পরিবর্তন ছাড়া সফল হতে পারে না। হিসাব বলছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১ লক্ষ ৫১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার (২০.৩ বিলিয়ন ডলার) ভর্তুকি কমাতে অচিরাচরিত শক্তি ব্যবহার করলে সেখান থেকে ১৯.৫ বিলিয়ন ডলার বছরে বাঁচাতে পারবে। 
ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন এই পরিবর্তনকে অর্থনৈতিকভাবে সাম্যের মধ্যে দিয়ে করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। যথাসম্ভব ন্যায্যভাবে সেই পরিবর্তন করার আহ্বান দেওয়া হয়েছে। সেখানে কাজের সুযোগ তৈরি করে কাউকে পিছিয়ে না রেখেই ওই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। কার্বন ভিত্তিক অর্থনীতি থেকে সবুজ অর্থনীতিতে ন্যায্য রূপান্তরের অর্থ হল যারা এখন কার্বন ভিত্তিক অর্থনীতিতে কাজ করে তাদের সকলের চাকরি রক্ষা করার সঙ্গে ওই সব বিকল্প ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কাজের সুযোগ তৈরি করতে হবে। 
কয়লা খনি শ্রমিকদের কী হবে?
২০২১ সালে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, প্রায় ৩৬ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভারতের কয়লা খনি ও কয়লা নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত। পর্যায়ক্রমে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে পুর্নব্যবহারযোগ্য শক্তির উৎসের দিকে অগ্রসর হতে গিয়ে কেউ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তা নিশ্চিত সরকারকেই করতে হবে। কয়লা বাতিলের সমর্থনে জি সেভেনের দেশ ২০২১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে একটি জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশন পার্টনারশিপ (জেইটিপি) তৈরি করেছে। ভারতের কানপুর আইআইটি’তে তৈরি হয়েছে এই সংক্রান্ত দেশের প্রথম গবেষণা কেন্দ্র (জেটিআরসি)। দেশের অনেক সংস্থা এই সুষ্ঠ শক্তি পরিবর্তন নিয়ে কাজ করাও শুরু করেছে। ভারত এখনো ওই সুষ্ঠ শক্তি পরিবর্তন নিয়ে তেমন কিছু ঘোষণা না করলেও কেন্দ্র সরকার নাকি সবুজ অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। 
পুর্ননবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি বৈদ্যুতিক যানবাহন, নতুন ব্যাটারি প্রযুক্তি এবং সবুজ হাইড্রোজেন ব্যবহারকে উৎসাহিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে অনেক দেশীয় সংস্থা। ভারতের প্রকল্প প্রবর্তনের নিয়ামক নীতি আয়োগ জানাচ্ছে, সবুজ হাইড্রোজেনকে কাজে লাগাতে পারলে ভারত ২০৫০ সালের মধ্যে ৩.৬ গিগাটন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন কমিয়ে শক্তি আমদানি পর্যন্ত সাশ্রয় করতে পারবে। এবছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি সরকারের তরফে সোনার বন্ডের মতো সভারিন গ্রিন বন্ড আনা হয়েছে।
                        
                        
বন্ড থেকে সংগৃহীত অর্থ জীবাশ্ম জ্বালানির ক্ষেত্র পরিবর্তনসহ নানান দূষণ নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হবে বলে প্রকাশ। কার্বন অধ্যুষিত অর্থনীতির ৪৫ শতাংশকে ২০৩০ সালের মধ্যে কমিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার। শুধু তাই নয় বিরাট এই দেশের বিদ্যুতের চাহিদার ৫০ শতাংশকে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে কমিয়ে পরিবেশ বান্ধব সৌর, বায়ু, জলের স্রোত ব্যবহারের চেষ্টা করা হবে। সবচেয়ে বড় কথা ২০৩০ সালের মধ্যে ২৫০-৩০০কোটি টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ উপযোগী সবুজ আগে তৈরি করতে হবে।   
                                        
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
Comments :0