EDITORIAL

মণিপুর: দায় বিজেপি সরকারের

সম্পাদকীয় বিভাগ

MANIPUR COMMUNAL VIOLENCE BENGALI NEWS editorial

কথিত আছে ঐতিহাসিক রোম নগরী যখন আগুনে পুড়‍‌ছে তখন সম্রাট নিরো প্রাসাদে বসে মনের সুখে বেহালা বাজাচ্ছেন। অনেকটা তারই প্রতিচ্ছবি দেখ গেল আরএসএস-বিজেপি শাসিত এ যুগের ভারতে। উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রান্তিক রাজ্য মণিপুর যখন সাম্প্রদায়িক হিংসা ও জাতি-উপজাতি দাঙ্গায় জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে তখন নিরো প্রতিম নরেন্দ্র মোদীরা বহুরূপী সাজে কর্ণাটকে মশগুল হয়ে আছেন ক্ষমতা দখলের ভোট প্রচারে। নিরীহ সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি, দোকানপাট লন্ডভন্ড করে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হচ্ছে। ভয়ে প্রাণ হাতে নিয় ভিটেমাটি ছেড়ে পালাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। 

ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় ঠিক কত লাশ পড়েছে তার হিসাব সরকার দিতে না পারলেও গুরুতর আহত সহস্রাধিক হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। রাস্তায় ইতস্তত ছড়ানো ছেটানো মরদেহ-ই জানান দিচ্ছে বিজেপি শাসিত এই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক, ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজনের রাজনীতির পরিণতি কতটা ভয়াবহ আকার নিতে পারে। অথচ কোনও তাপ উত্তাপ নেই বিভাজনের রাজনীতির অন্যতম হোতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যা তাঁর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ’র। কর্ণাটকে ভোট প্রচারে তাদের বেপরোয়া ও মরিয়া মনোভাবই বুঝিয়ে দিচ্ছে মণিপুর নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় তাদের বিশেষ নেই।


মায়ানমার সীমান্তে তিন রাজ্য আসাম, নাগাল্যান্ড ও মিজোরাম পরিবেষ্টিত মণিপুর প্রধানত আদিবাসী অধ্যুষিত পাহাড়ি রাজ্য। উপত্যকা বলতে ঘনবসতিপূর্ণ ইম্ফল উপত্যকা যা রাজ্যের মোট এলাকার এক দশমাংশ। এখানেই বাস রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইটেই সম্প্রদায়ের। অবশিষ্ট এলাকায় পাহাড় জঙ্গলকে ঘিরে বাস করে স্বীকৃত ৩৪টি উপজাতি গোষ্ঠী। রাজ্যের মোট ২৮ লক্ষ জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ এই উপজাতিরা। সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইটেই সম্প্রদায়ের সঙ্গে উপজাতি গোষ্ঠীগুলিকে স্বার্থে সংঘাতে প্ররোচিত করেই এই দাঙ্গার আগুন জ্বালানো হয়েছে। বিভাজনের রাজনীতিকে ব্যবহার করে মেরুকরণের তীব্রতাই বি‍‌জেপি’র ভোট জয়ের প্রধান কৌশল। ক্ষমতা ধরে রাখতে বা ক্ষমতায় টিকে থাকতে রাজ্যে রাজ্যে এই কৌশলই অনুসরণ করে হিন্দুত্ববাদের ঠিকাদাররা। কর্ণাটকেও সেই বিভাজনের রজানীতিকে কাজে লাগিয়ে মেরুকরণ তীব্র করে ক্ষমতায় ফিরতে চাইছে তারা। তাই কর্ণাটকেই পড়ে আছেন মোদী-শাহ’রা।


ভোটের বাজারে জয়ের লক্ষ্যে বিজেপি জাত-সম্প্রদায়গত প্রশ্রয় দেয়। কখনো ধর্মীয় সংখ্যাগুরু, কখনো জাত-সম্প্রদায়গত সংখ্যাগরিষ্ঠকে সঙ্গে রাখার তাগিদে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নানাভাবে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে সংখ্যাগুরুদের এককাট্টা করার চেষ্টা করে। দেশের অন্যত্র হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করার চেষ্টা হলেও মণিপুরে তারা জাতিগত বিভাজনকে বাড়তি গুরুত্ব দেয়। তাদের হিসাব অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইটেই সম্প্রদায়কে হাতে রাখতে পারলে ক্ষমতা ধরে রাখা সহজ। তাই আদিবাসীদের সঙ্গে মেইটেইদের বিরোধ, স্বার্থের সংঘাত বাধানোই তাদের কৌশল হয়ে যায়। সরকার সেই কৌশল প্রয়োগ করে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে। তাদের বনজঙ্গলের অধিকার কেড়ে নেবার চেষ্টা করে। বিগত কয়েক বছরে বহু বনবস্তি থেকে আদিবাসীদের উৎখাত করা হয়। ভে‍‌ঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় একের পর এক গির্জা। বংশপরম্পরা বসবাসকারী আদিবাসীদের দখলদারি বলে চলছে বুলডোজার অভিযান।


হালে উদ্যোগ শুরু হয়েছে রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইটেই সম্প্রদায়কে উপজাতি হিসাবে স্বীকৃতিদানের। এই ঘটনা আতঙ্ক তৈরি করে আদিবাসীদের মধ্যে। তারা অশনি সংকেত দেখতে পান। মেইটেই আদিবাসী স্বীকৃতি পেলে প্রকৃত আদিবাসীদের জঙ্গল অঞ্চলের সাংবিধানিক অধিকার চলে যাবে। তাতে প্রবলভাবে ভাগ বসাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইটেই। দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়ার এই পরিস্থিতিতে তারা প্রতিবাদে মুখর হয়ে রাস্তায় নামে। বস্তুত এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে বিজেপি সরকার। তাই পুলিশের সামনে দাঙ্গার আগুন জ্বললেও পুলিশ নীরব।
কর্ণাটকে ভোট প্রচারে মোদীরা বার বার বলছেন বিরোধীরা সরকারে এলে দাঙ্গা বাধাবে। মিজোরাম হাতেনাতে প্রমাণ করে দিয়েছে বিজেপি ক্ষমতায় থাকলে দাঙ্গা অনিবার্য।

Comments :0

Login to leave a comment