চন্দন দাস
যে জন্ম নিয়েছে আজ পশ্চিমবঙ্গে সে জানলো না, কিছুই বুঝলো না। তার মাথায় ধার চাপলো প্রায় ৭৫হাজার টাকার। সামগ্রিকভাবে রাজ্যবাসীর কাঁধে তৃণমূলের সরকার ধারের চাপিয়েছে প্রায় ৭লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকার। আগামী কয়েকমাসে তা আরও বাড়বে।
এখন নবজাতকের কানে ‘জয় বাংলা’ বলে কী স্বাগত জানানো উচিত?
গড় বার্ষিক উৎপাদন একটি রাজ্যের বাসিন্দাদের আর্থিক অবস্থার অন্যতম মানদন্ড। রাজ্যের মাথা পিছু গড় বার্ষিক উৎপাদন ৮২,৭৮১ টাকা। কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল এবং রাজ্য মিলিয়ে দেশের ৩৩টি ভূখন্ডের মধ্যে এই ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ আছে ২৪ নম্বরে। মমতা ব্যানার্জির স্বরে স্বর মিলিয়ে ‘জয় বাংলা’ কী বার তিনেক বলে নেওয়া যায়?
রাজ্যের মানুষের এই আর্থিক দুর্দশার বিচারে রামমন্দির পাওয়া উত্তর প্রদেশ আছে পশ্চিমবঙ্গের পিছনে। বিজেপি শাসিত আসাম, ঝাড়খন্ডের মতো রাজ্যও পশ্চিমবঙ্গের পিছনে। আমাদের কী আহ্লাদিত হওয়া উচিত? চিৎকার করে ‘জয় বাংলা’ বলা উচিত, যেমনটি বিধানসভায় দেখা গেল সম্প্রতি?
পিছন দিকে এগিয়ে চলার কৃতিত্ব পশ্চিমবঙ্গ দাবি করতে পারে। এই সাফল্য তৃণমূলের। আরও নির্দিষ্ট করে বললে মমতা ব্যানার্জির। কারণ তিনিই তৃণমূল। এখন তিনিই পশ্চিমবঙ্গের সমার্থক হয়ে উঠতে চাইছেন। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান নিয়ে তৃণমূলের মাতামাতির এটিই কারণ। বিজেপি মমতা ব্যানার্জির বাঁয়া ধরেছে। কারণ— তাদের শাসিত রাজ্যগুলির অবস্থাও খারাপের দিকে। দেশ ডুবিয়ে তারা বলতে শুরু করেছে ‘বাংলা বাঁচাও।’
২০১১-তে তৃণমূলের স্লোগান ছিল ‘সততার প্রতীক’ এবং ‘বদলা নয় বদল চাই।’ এবার তৃণমূল নিয়ে আসতে চাইছে ‘জয় বাংলা’।
‘সততার প্রতীক’ প্রহসনে পরিণত হয়েছে। ‘বদলা নয় বদল চাই’—এর নামে তৃণমূল কী করেছে, পঞ্চায়েত থেকে বিধানসভা, প্রতিটি নির্বাচনে ভোট লুট, বুথ দখলের রক্তাক্ত ঘটনাগুলির মধ্যে দিয়ে তৃণমূল প্রমাণ করেছে। গণতন্ত্র প্রায় ধুলিস্যাৎ হয়েছে রাজ্যে।
এখন দুর্নীতি, বেকারি, শাসকের নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে জনজাগরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গেও মানুষের সেই সঙ্কটগুলি অত্যন্ত গুরুতর বিষয় হিসাবে উপস্থিত হয়েছে মমতা ব্যানার্জির শাসনে। এই পরিস্থিতিতে ‘জয় বাংলা’য় জোর দিচ্ছেন তৃণমূল নেত্রী।
এখন ইতিহাস ভুলিয়ে, দুমরে মুচড়ে নতুনন করে লেখা প্রবল প্রয়াসে আছে দক্ষিণপন্থা। মমতা ব্যানার্জিকেই দেখা যাক।
গত ২৮ জুলাই মেয়ো রোডে তৃণমূলের সভায় এবং গত বৃহস্পতিবার বিধানসভায় মমতা ব্যানার্জি বিজেপি’র উদ্দেশ্যে বলেছেন,‘‘তোমরা ইংরেজদের দালালি করেছো। তোমরা বিশ্বাসঘাতক।’’ বিধানসভায় নাথুরাম গডসেকে বিজেপির নেতাও বলেছেন। মেয়ো রোডের সভায় বলেছেন,‘‘তোমাদের প্রপতিতামহ ইংরেজদের কাছে মুচলেকা দিয়েছিল।’’ কমিউনিস্টরা যে কথা প্রায় আশি বছর ধরে বলছে, সেই কথা এখন মমতা ব্যানার্জির মুখে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু আনন্দ হচ্ছে না। প্রশ্ন হাজির হচ্ছে। আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে।
প্রশ্নের কারণ— যদি বিজেপি ‘বিশ্বাসঘাতক’ হয়, তাহলে বিজেপি’র প্রাণপুরুষ, তৎকালীন হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ সম্পর্কে সেদিন ‘অটল’ বলেছিলেন কেন? যদি বিজেপি’র ‘প্রপিতামহ’ বিনায়ক দামোদর সাভারকার ব্রিটিশের কাছে মুচলেকা দিয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করেছিলেন বলে মমতা ব্যানার্জি মনে করেন, তাহলে সেই বিজেপি’র সঙ্গে দল তৈরির পর থেকেই তিনি আঁতাত করেছিলেন কেন? কেন তাদের সরকারের শরিক হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছিলেন বারবার? কেন সিঙ্গুরে শিল্প আটকানোর জন্য ধর্মতলায় রহস্যময় অনশন মঞ্চে বিজেপি’র নেতা, সাভারকারের অনুসারী রাজনাথ সিংকে বসতে দিয়েছিলেন? কেন ‘বিশ্বাসঘাতক’দের উত্তরসূরীকে বাড়িতে ডেকে মালপোয়া খাইয়েছিলেন? কেন ১৯৯৭-এ কংগ্রেস থেকে বহিষ্কারের কয়েক ঘন্টা আগে কলকাতার সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন,‘‘বিজেপি অচ্ছুৎ নয়।’’ কেন গেছিলেন ২০০৫-এর ১৫ সেপ্টেম্বর নাথুরামের প্রকৃত সংগঠন আরএসএস-এর সভায়। যেখানে তিনি আদবানী, নরেন্দ্র মোদীদের মতো স্বয়ংসেবকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,‘‘আমি জানি আপনারা প্রকৃত দেশপ্রেমিক।’’ সেই সভাতেই তাঁকে ‘সাক্ষাৎ দূর্গা’ হিসাবে সম্ভাষণ করেছিলেন ‘ব্রিটিশের দালাল’ সংগঠনের নেতারা।
কৌশলে বিজেপি’র মতো সাম্প্রদায়িক শক্তির পতাকা বহনকারীদের স্লোগান ‘জয় বাংলা’ হতে পারে না।
কিন্তু তৃণমূল চাইছে ‘জয় বাংলা’ আর মমতা ব্যানার্জি সমার্থক হোক। বাংলাপ্রেমী হিসাবে তৃণমূল নেত্রীর নাম অক্ষয় হোক। এই ভাবেই রাজ্যে পরিসর বাড়ুক আরএসএস-এর।
কিন্তু স্মৃতি কখনও কখনও বিরুদ্ধতার চাবুকে শান দেয়। স্মৃতিই টেনে আনে ২০০০-র ৬ জুলাই।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী সেদিন কালীঘাটে মমতা ব্যানার্জির বাড়িতে মালপোয়া খেয়েছিলেন। তার আগে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে, নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে বাজপেয়ীর উপস্থিতিতে তৃণমূল নেত্রী বলেছিলেন,‘‘শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিও ‘অটল’ ছিলেন। আর অটলজীও ‘অটল’। তাই তাঁদের মধ্যে এত মিল।’’
সেদিনই নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠানের আগে রাজভবনে এক প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন এক প্রতিনিধি দল। মাত্র পাঁচ মিনিট সময় দিয়েছিলেন বাজপেয়ী। মমতা ব্যানার্জি তখন বাজপেয়ীর সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে আছেন। কিন্তু তিনি প্রতিনিধি দলের জন্য বাড়তি সময়ের সুযোগ করে দেওয়ার কোনও উদ্যোগই নেননি। সেই প্রতিনিধি দলে ছিলেন রাজ্যসভার তৎকালীন সাংসদ, সিআইটিইউ নেতা কমরেড দীপঙ্কর মুখার্জি। আর ছিলেন সেই চারটি কারখানার শ্রমিকরা, যেগুলি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তার আগে, ২৩শে জুন বিজেপি-জোট সরকারের মন্ত্রীসভা দেশের অনেকগুলি রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা বেসরকারীকরণ, বিলগ্নীকরণের সিদ্ধান্ত নেয়। দেশের কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা বন্ধের সিদ্ধান্তও সেদিন নিয়েছিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা। মমতা ব্যানার্জি ছিলেন সেই সিদ্ধান্তের শরিক। যে কারখানাগুলি বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তার মধ্যে ৪টি ছিল পশ্চিমবঙ্গে। সেগুলি হলো — ভারত প্রসেস, এমএএমসি, ওয়েবার্ড ইন্ডিয়া এবং আরআইসি। সেই সিদ্ধান্ত ঘোষিতও হয়েছিল। সেদিন বামপন্থীদের নেতৃত্বে শ্রমিকদের প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থার বিলগ্নীকরণের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। আর ‘শ্যামাপ্রসাদের মত অটলজী’-কে মালপোয়া খাইয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি।
বাংলার এই সামগ্রিক বিরোধিতাই মমতা ব্যানার্জির উত্থানের অন্যতম মাধ্যম। অনেক প্রমাণ।
১৯৯৯-এ গুজরাটে ভূমিকম্প। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছিলেন গুজরাটে। তখন তিনি রেলকর্মীদেরও বলেছিলেন তাঁদের বেতন থেকে গুজরাটে সাহায্য করতে। কোনও অন্যায় নেই তাতে। সিপিআই(এম) সহ বামপন্থীরা অর্থ, ত্রাণ সংগ্রহ করে গুজরাটে পাঠিয়েছিলেন।
কিন্তু ২০০০-এ কী হলো? রাজ্যে প্রলয়ঙ্কর বন্যা। ৯টি জেলা বিধ্বস্ত। দু’ কোটির বেশি মানুষ আক্রান্ত। সেদিন মমতা ব্যানার্জি কিংবা তৃণমূলের কোনও নেতা সেই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াননি। বরং ঠিক সেই সময়ে রাজ্যে ৩৫৬ নং ধারা প্রয়োগের দাবি তুলেছিলেন। সেই দাবি নিয়ে রাজ্যের সেই অবস্থার মধ্যে গেছিলেন এনডিএ-র শরিকদের কাছে। যাতে বামফ্রন্টের সরকার ভেঙে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করায় তারা সাহায্য করেন, সেই তদ্বির করতে। রাজ্যে ফিরে বন্যা সংক্রান্ত নিজের ব্যাখ্যা হাজির করেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী — ‘ম্যান মেড বন্যা।’ পশ্চিমবঙ্গের মানুষের দুর্দশা সেদিন তিনি পাত্তা দেননি। বন্যা বিধ্বস্ত পশ্চিমবঙ্গকে পর্যাপ্ত কেন্দ্রীয় সাহায্য দিতে হবে — এই দাবিতে ২০০০-র ৭ই ডিসেম্বর কমরেড জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে সংসদ ভবনের সামনে এই রাজ্যের বামফ্রন্ট বিধায়করা অবস্থান করেছিলেন। সেদিন মমতা ব্যানার্জিও সংসদ ভবনের সামনেই ছিলেন। তবে তিনি তার দলবল নিয়ে গান্ধীমূর্তির নিচে ধরনায় বসেছিলেন — রাজ্যে ৩৫৬ নং ধারা প্রয়োগের দাবি নিয়ে।
বিজেপি আর তৃণমূল বরাবরের সহযোগী। বাংলা-বিরোধিতায় তারা পরিপূরক, শরিক।
এখন তাদের ধর্মের নামে বিভাজনের কৌশল আছে। সরকারি টাকায় মন্দির, শিবলিঙ্গ তৈরি করে, সতী-মাহাত্ম্য প্রচার করে, রামনবমীতে অস্ত্র হাতে মিছিল করে ‘কে বড় হিন্দু’, তা নিয়ে বিজেপি’র সঙ্গে প্রতিযোগিতা চালিয়েছে, চালাচ্ছে এবং চালাবে তৃণমূল। কিন্তু বেকারি, দুর্নীতি, নারী নির্যাতনের মতো সঙ্কটগুলি প্রবল উষ্মার জন্য দিয়েছে গ্রাম, নগরে। এই সময়ে বাংলা-স্বাভিমানকে অস্ত্র করার চেষ্টা শুরু করেছে মুখ্যমন্ত্রীর দল। বিধানসভার অধিবেসনে সম্প্রতি টানা চিৎকার শুনলাম আমরা—‘জয় বাংলা’। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সেই চিৎকারের উদ্যোক্তা ছিলেন। তৃণমূলের বিধায়ক, সরকারের মন্ত্রীরা সেই চিৎকারে গলা মিলিয়ে বিধানসভা আলোড়িত করেছেন।
‘জয় বাংলা’ সোচ্চারে উচ্চারিত হয় ১৯৭১-র ৭ই মার্চ। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল সমাবেশে মুজিবুর রহমান বলেছিলেন,‘‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’’ ১৯৭১-এর ২৫ মার্চে তাঁর আহ্বানেও ছিল সেই স্লোগান। একটি সূত্র জানাচ্ছে, ১৯৬৯-র ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে শিক্ষা দিবস যৌথ ভাবে পালনের জন্য কর্মসূচী ঠিক করতে ছাত্রদের সভা হয়। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সেই সভায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আফতাব আহমেদ ও চিশতি হেলালুর রহমান ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন। ১৯৭০-র ১৯ জানুয়ারি ঢাকার পল্টনের এক সভায় ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান তাঁর বক্তব্যের সময় ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করেন। গবেষকদের মতে ১৯২২-এ তাঁর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কবিতায় কবি নজরুল ইসলামের লেখাতে ‘জয় বাংলা’-র উদ্ভব।
‘জয় বাংলা’ স্বাধীনতার জন্য মরীয়া এক জাতির সংগ্রামের স্লোগান। জিন্নাহ সহ পাকিস্তানের শাসকদের ঊর্দুকে একমাত্র ভাষা হিসাবে বাংলাদেশে চাপিয়ে দেওয়ার গা জোয়ারি কৌশলের মুখোমুখি রুখে দাঁড়ানো সব অংশের মানুষের আত্মসন্মানের প্রকাশও ‘জয় বাংলা’য়। আবার ‘জয় বাংলা’কে ভিত্তি করেই জাতীয় বুর্জোয়ারা মাথা তোলার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ-লালিত সামন্ততন্ত্র নিজেকে রক্ষা করেছে। সাম্প্রদায়িক অপচেতনাও ‘জয় বাংলা’-র আবডালে নিজের সাময়িক নিরাপদ নির্বাসন খুঁজে নিয়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনার ধারক ‘জয় বাংলা’র স্লোগান।
কী আশ্চর্য! ‘নাস্তিক’ বলে জাভেদ আখাতারের অনুষ্ঠান বন্ধের কারিগর মৌলবাদী শক্তির সমর্থকরাও এই বাংলার বিধানসভায় ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করছেন। আবার এক সংখ্যালঘু ছাত্রকে ‘পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেবো’ বলে হুমকি দেওয়া মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রীও তৃণমূলের বিধায়ক হিসাবে একই স্লোগানে চিৎকার করছেন। অথচ রাজ্যের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কয়েক হাজার বাংলা বিভাগের শিক্ষক পদ ফাঁকা। নিয়োগের দাবি বিধানসভার বাইরে হাজারও শিক্ষক লড়ছেন।
এই বাংলায় এখন তৃণমূলের ‘জয় বাংলা’ আর মানুষের দাবি ‘কাজ চাই’, ‘চোর হঠাও’ দাঁড়িয়ে গেছে মুখোমুখি। অথচ দুটি স্লোগান গভীর ভাবে সম্পৃক্ত, পরিপূরক। কাজ হলে, চাকরি হলে পশ্চিমবঙ্গ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। তার জন্য কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম, শিল্পের বিকাশ, কর্মসংস্থান প্রয়োজন। তখনই ‘জয় বাংলা’ অনেকটা সার্থক হতে পারবে। কিন্তু সব কিছু থেকে কাটমানি খাওয়া দলের শাসনে তা সম্ভব নয়।
তাই তৃণমূল কিংবা বিজেপি’কে রেখে তা সম্ভব নয়। প্রমাণ অনতিদূরের ইতিহাস।
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন বিজেপি-শাসিত রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের বাংলায় কথা বলার জন্য বাংলাদেশি হিসাবে চিহ্নিত করে তাঁদের হেনস্থা করা হয়েছে। বেশ কয়েকজনকে বাংলাদেশে পুশব্যাক করা হয়েছে। এখনও অন্তঃসত্বা সোনালি বিবি সহ ৬জন বাংলাদেশের জেলে বন্দি। এই পরিস্থিতিতে বাঙালি অস্মিতাকে জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে তৃণমূল ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে ব্যবহার করতে নেমেছে। তাৎপর্যপূর্ণ হলো ‘বাংলাভাষী মানেই বাংলাদেশি’— এই ভাষ্যের পিছনে বিজেপি’র অজুহাত অনুপ্রবেশ। তাদের দাবি বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মাটিকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের অনেক মানুষ ভারতে ঢুকে পড়েছে। আর তাদের এই দাবি, যা মূলত আরএসএস-এর বক্তব্য, তা সংসদে উত্থাপন করেছিলেন মমতা ব্যানার্জিই। পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ নিয়ে আলোচনা করতে চেয়ে লোকসভায় হট্টগোল করেছিলেন তিনি। ২০০৫-এর ৪আগস্ট। উপাধ্যক্ষ চরণজিৎ অটওয়ালের দিকে কাগজের বান্ডিল ছুঁড়ে মেরেছিলেন তিনিই। তিনিই দাবি করেছিলেন যে, পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ হয়। আর ‘বাংলাদেশি’ ভুয়ো ভোটার খুঁজে দেখতে দায়িত্ব দিয়েছিলেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে। কিন্তু তাঁর স্নেহের ‘বালু’ খুঁজে পাননি ভুয়ো ভোটার।
আজ বলছেন— ‘জয় বাংলা’, ভোটার তালিকা থেকে কারও নাম কাটতে দেবো না! অথচ বিজেপি’র হাতে তো তিনিই অস্ত্র তুলে দিয়ে বসে আছেন। ভুয়ো ভোটার, মৃত ভোটারদের ব্যবহার করে তৃণমূল নির্বাচনে জালিয়াতি করে। বামপন্থীরা তার অনেক উদাহরণ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে একাধিকবার উপস্থিত হয়েছে। রাজ্যের মানুষ জানেন তৃণমূলের এই কারসাজি। এখন ‘জয় বাংলা’ বলে সেই ভুয়ো ভাটারদের নাম তালিকায় বজায় রাখার চেষ্টা শুরু করেছেন মমতা ব্যানার্জি।
এই স্লোগানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা যাবতীয় তাত্বিক, ঐতিহাসিক প্রসঙ্গগুলিকে সরিয়ে রেখেও আমাদের মনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, গরিব কৃষকের মধ্যে জমি বন্টন এবং পঞ্চায়েত গঠনের মাধ্যমে দেশে পশ্চিমবঙ্গ এক উদাহরণ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সাফল্যের ভিতের উপর দাঁড়িয়ে শিল্পের বিকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়িত হলে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গ এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছত পারতো। সেই অস্মিতা প্রতিষ্ঠার কালে মমতা ব্যানার্জি কী করেছিলেন? পশ্চিমবঙ্গকে শিল্পে এগিয়ে যাওয়া রাজ্যের জায়গা থেকে গুজরাট, মহারাষ্ট্র, ওডিশা, ছত্তিশগড়, দিল্লিতে বিনিয়োগকারী শিল্পপতিদের শস্তা শ্রমের বাজারে পরিণত করার সময় তাঁর ‘জয় বাংলা’র মনোভাব কোথায় ছিল? আজ যাদের তিনি বিরোধী হিসাবে চিহ্নিত করতে চাইছেন, সেই বিজেপি তখন তাঁর পাশেই ছিল।
অতীতের সেই ভূমিকা ঢেকে ‘জয় বাংলা’ বলে হাঁক পাড়ার পিছনে অন্যতম কারণ মমতা ব্যানার্জি নিজেকে বাংলাপ্রেমী হিসাবে প্রমাণ করতে চান। কতটা পশ্চিমবঙ্গ প্রেমী মমতা ব্যানার্জি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই হবে, জবাব দিতেই হবে। নাহলে ‘বাংলা’ নিয়ে ‘খেলবে’ দুই বাংলা-বিরোধী— তৃণমূল-বিজেপি।
মন্তব্যসমূহ :0