যে কোনও ধর্মের মানুষ তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে পারেন স্বাধীনভাবে। সেখানে সরকার বা রাষ্ট্রের খবরদারি বা কর্তৃত্ব কায়েম ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান সকল ধর্মের মানুষকেই সেই অধিকার ও স্বাধীনতা দিয়েছে। যদি কোথাও গুরুতর কোনও অনিয়ম বা বেআইনি কাজ হয়ে থাকে তবে সরকার অবশ্যই আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু সরকার যদি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের থেকে কেড়ে নিজের কর্তৃত্ব কায়েম করতে চায় তাহলে বুঝতে হবে সরকার নিজেই সংবিধানকে অস্বীকার করছে, সংবিধানের বিরুদ্ধাচারণ করছে। সেক্ষেত্রে দেশের সর্বোচ্চ আদালত হস্তক্ষেপ করবে সেটাই স্বাভাবিক। যথারীতি সুপ্রিম কোর্ট সেটাই করেছে। মোদী সরকারের তৈরি করা ‘ওয়াকফ সংশোধনী আইন ২০২৫’-র কয়েকটি বিতর্কিত ধারা অন্তর্বর্তীকালীন রায় স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে। যে ধারাগুলি স্থগিত হয়েছে তার সবগুলি সম্পর্কেই গুরুতর আপত্তি জানিয়েছিল বিরোধী দলগুলি। সরকার সেগুলিকে বিবেচনার ন্যূনতম আগ্রহ না দেখিয়ে পত্রপাঠ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। এখন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে প্রমাণ হয়ে গেছে বিরোধীরা সঠিক ছিল। সেদিন যদি সরকার বিরোধীদের মতামতকে গুরুত্ব দিত তাহলে আজ এমন বেইজ্জতি হতো না।
মূলত দু’টি প্রধান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সরকার সংবিধানের বিরুদ্ধ অবস্থান নিয়ে তড়িঘড়ি ওয়াকফ আইন সংশোধনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। প্রথমত, সংখ্যালঘু মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে ধর্মীয় বিরোধ ও সংঘাতের জমি তৈরি করা। তাতে প্রবল বিদ্বেষ-ঘৃণার আবহে ধর্মীয় বিভাজন ও মেরুকরণ তীব্র করা যাবে। আরএসএস-বিজেপি’র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির স্বার্থেই সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় পরিসরে হস্তক্ষেপ করার ব্যবস্থা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ওয়াকফের অধীনে সারা দেশে বিপুল সম্পত্তি আছে। মূলত শহরাঞ্চলে এই সম্পত্তির মূল্য লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা। সরকারের শকুনের নজর পড়েছে এই জমির দিকে। ওয়াকফের অধীন থেকে এই জমি সরকারের অধীনে এনে তারপর বেসরকারি কর্পোরেট ও প্রোমোটারদের হাতে তুলে দিতে চায় সরকার। একদিকে বেসরকারি সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় লোভনীয় জমি পাবে অপেক্ষাকৃত কম দামে আর সরকার ফাঁকতালে পেয়ে যাবে মোটা টাকা।
এই দুই প্রধান উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই আইন সংশোধন করা হয় সংবিধানকে উপেক্ষা করে। ওয়াকফের হাতে নতুন করে সম্পত্তি আসা ঠেকাতে ধারা যুক্ত হয় অন্তত পাঁচ বছর মুসলিম ধর্মাচরণ না করলে ওয়াকফে সম্পত্তি দান করা যাবে না। বিতর্কিত ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা দেওয়া হয় জেলাশাসককে। অর্থাৎ আমলাকে দিয়ে ওয়াকফ সম্পত্তি হাতিয়ে সরকারের অধীনে আনার ব্যবস্থা। কোনও জমি সরকার দখল করতে চাইলে কাউকে দিয়ে অভিযোগ দাখিল করে সেই অভিযোগের ভিত্তিতে সেই জমি জেলাশাসক সরকারের অধীনে নিয়ে আসতে পারবেন। কেন্দ্র ও রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্য বাড়িয়ে বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ মুসলিমদের হাত থেকে কেড়ে নেবার ব্যবস্থা হয়েছে। অমুসলিম বেশি থাকলে মুসলিমদের ধর্মীয় সংস্থা পরিচালনায় মুসলিমদের ভূমিকা কমে অমুসলিমদের ভূমিকা বাড়বে।
সংশোধন করে এই তিনটি ধারা যুক্ত করেছিল সরকার। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট তিনটি ধারারই প্রয়োগ স্থগিত করে দিয়েছে। বাকি ধারাগুলি নিয়ে অবশ্য কোর্ট হস্তক্ষেপ করেনি। যদিও মুসলিমদের সংগঠন এবং বিরোধী দলগুলি গোটা সংশোধনী আইনটাই বাতিল করার দাবি জানিয়েছে।
Editorial
ওয়াকফে মুখ পুড়ল মোদী-শাহর

×
Comments :0