BUDGET 2024

আত্মবিশ্বাসের মোড়কে

সম্পাদকীয় বিভাগ


জোর প্রচার চলছে এটা নাকি প্রবল আত্মবিশ্বাসী বাজেট। গত এক দশকে মোদী জমানায়‌ উন্নয়নের যে জোয়ার বয়ে গেছে তাতেই নাকি মানুষ দারুণ খুশি। তাই নতুন করে আর রেউড়ি বিলির নাকি প্রয়োজন হয়নি। এমনকি কৃষি, গ্রামীণ উন্নয়ন, সমাজ কল্যাণ থেকে শুরু সাধারণ মানুষের জন্য ব্যয় বরাদ্দ বি‍‌শেষ বাড়ানো হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বরাদ্দ কমিয়ে ফেলা হয়েছে। তৃতীয় বারের জন্য ভোটে জেতা যেহেতু শুধু সময়ের অপেক্ষা তাই সাধারণ মানুষের জন্য অকারণ বাড়তি খরচ করতে চাননি অর্থমন্ত্রী। এমনিতেই যখন ভোটে জেতা যাবে তখন গ্রাম উন্নয়ন, কৃষি, কল্যাণ প্রকল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদিতে বাড়তি খরচ করে অপচয় না করাকেই সঠিক বলে বিবেচনা করেছেন সীতারামন। মোদীর নির্দেশে তাই তিনি আত্মবিশ্বাসী ভোটে বাজেট পেশ করেছেন। অবশ্য ভোট প্রচারে গিয়ে যথেচ্ছ রেউড়ি প্রতিশ্রুতি দিতে বাধা নেই। যেমন কয়েক মাস আগে কয়েক রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আগে দেওয়া হয়েছিল।
প্রসঙ্গত এই আত্মবিশ্বাস শুধু এবারের বাজেটে দেখানো হয়নি। তার সূচনা হয়ে গেছে চলতি অর্থবর্ষে (২০২৩-২৪) বাজেট বরাদ্দ থেকে প্রকৃত ব্যয় অনেকটা কমিয়ে ফেলার মধ্য থেকে। অর্থাৎ বরাদ্দ অনুযায়ী খরচ হলে রাজকোষ ঘাটতি অনেক বেড়ে যাবে। প্রকারান্তরে বাজার থেকে সরকারকে অনেক বেশি ঋণ নিতে হবে। কর্পোরেট পুঁজি সরকারের বেশি ব্যয়‌, বেশি ঋণ পছন্দ করে না। তাতে বাজারে সুদের হার বেশি থাকে। কর্পোরেট মুনাফা কম হয়। সরকার রাজস্ব ব্যয় কমিয়ে বাজার থেকে ঋণ নেওয়া কমিয়ে দিলে সুদের হার কমে যাবে। তাতে ব্যাঙ্ক-ডাক ঘরে সাধারণ মানুষের আমানত থেকে আয় কমে গেলেও কর্পোরেটে লাভ। মোদী সরকার কর্পোরেটের সুবিধাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে।
সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে বরাদ্দ না বাড়লেও মূলধনী খাতে ব্যয় বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখা হয়েছে। বোঝানো হয়েছে ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’, ‘আত্মনির্ভর ভারত’, ‘সাত ট্রিলিয়ন অর্থনীতি’ এবং ‘বিকশিত ভারতে’র জন্য নাকি এটা জরুরি। অর্থনীতির বিকাশের গতি ধরে রাখতে হলে সামগ্রিক পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে ব্যয় অর্থাৎ মূলধনী ব্যয় বাড়াতে হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে নানা খাতে কর্পোরেটকে নানান ছাড়-সুবিধা দেবার পরও বেসরকারি মূলধনী ব্যয় কিন্তু থমকে আছে। তাদের মুনাফা বাড়লেও কর্পোরেট নতুন বিনিয়োগে উৎসাহ দেখাচ্ছে না, তাই সরকারকে একাই সেই দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। আর সেটা করতে গিয়ে সাধারণের খাতে ব্যয় ছাঁটাই হয়ে যাচ্ছে। কর্পোরেট বিয়োগের অনীহার মূলে তাদের ইতিমধ্যে তৈরি উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার হচ্ছে না পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা কমে যাওয়ায়। তাই বিনিয়োগ করার জন্য পর্যাপ্ত মূলধন তাদের হাতে থাকলেও তারা হাত গুটিয়ে বসে আছে।
কেন এমন হলো? মানুষের আয় না বাড়লে, বেকারদের চাকরি না হলে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে না। ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লে বাজারে পণ্য-পরিষেবার চাহিদা বাড়ে না। ভারতের অর্থনীতিতে সেই নিশ্চলতা এখন বিরাজ করছে। এই মৌলিক সমস্যাকে নজর এড়িয়ে অর্থমন্ত্রী বাজেটকে গত দশ বছরের সাফল্যের খতিয়ান বানিয়েছেন। নির্মম বাস্তবতাকে অস্বীকার সাফল্যের অবাস্তব রঙিন আলোয় সাজিয়ে দাবি করছেন মোদী ক্ষমতায় আসার আগে দেশের অর্থনীতি কখনই শক্তি ভিতের ওপর সুশৃঙ্খলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মোদীই সেটা করে দেখিয়েছেন। আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। এবার শুধু এগিয়ে যাবার পালা। কিন্ত কে এই নির্বোধ চাটুকারদের বোঝাবে যে স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে উচ্চ হারে অর্থনীতির বিকাশ হয়েছিল ২০০৩ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে। তখন গড় বার্ষিক বৃদ্ধির হার ছিল ৮ শতাংশের উপর। আর ১৯৯১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে কম বৃদ্ধির হার মোদী শাসনের এক দশকে।

Comments :0

Login to leave a comment