Mrinal Sen cinema

সিনেমা যখন রাজনৈতিক

কলকাতা


জয়দীপ মুখোপাধ্যায়
“কলকাতা আমাকে তৈরি করেছে, আমাকে রূপ দিয়েছে, অনুপ্রাণিত করেছে, হতাশ করেছে,  কাঁদিয়েছে, হাসিয়েছে, ভাবিয়েছে, আমাকে উস্কে দিয়েছে। আমার অস্তিত্বের থেকেই বিকশিত হয়েছে কলকাতার সমসাময়িক সংবেদনশীলতা, যা আমার সিনেমাকে সমৃদ্ধ করেছে।” – মৃণাল সেন।
শহরটা এখন যেন কেমন কেমন! মনে হয় তাই। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সব কিছু যেমন বদলে যায়।
মৃণাল সেন তাঁর ‘পদাতিক’ ছবির প্রারম্ভে যেমন বলেছিলেন, “ফিরে ফিরে যতবার কলকাতায় আসি... যতবার... মনে হয় কলকাতা বোধহয় একেবারে থেমে যাবে। আর চলবে না। তবু কলকাতা চলেই চলেছে।”  
“শেষ নেই। কোনও শুরু নেই। আছে শুধু জীবনের আবেগ”। বিখ্যাত ইতালীয় পরিচালক ফেদরিকো ফেলিনির এই উদ্ধৃতি যদি সত্যি হয়, শতবর্ষে মৃণাল সেন ফিরে এলেন কলকাতার মহাপৃথিবীতে প্রতিটি নাগরিক আবেগে, মননে, কর্মে, চিত্তলোকে। মৃণাল সেন ফিরে এলেন আমাদের সঙ্গে নিয়ে তাঁর প্রিয়তম কলকাতাকে একবার অনুভব করতে, একবার স্পর্শ করতে। পঞ্চাশ বছর আগে যেন একসময়— মেশিন আমাদের নিয়ে চলেছে সত্তরের কলকাতায়। সব হিসাবের বাইরে থাকা লড়াই, আবেগ আর ভালোবাসার কলকাতায়। 
“এ-দেশের যে শহরটা, শুনে থাকি বারুদে ঠাসা- তার নাম কলকাতা। কলকাতায় মিছিল, আওয়াজ, প্রতিবাদ। কলকাতায় বিক্ষোভ, ক্রোধ, ব্যারিকেড আর বোমা। কলকাতা বেপরোয়া, কলকাতা মারমুখী। আমি কলকাতার মানুষ। আমি কলকাতার মিছিলে শামিল হয়েছি বারবার। মিছিলে আওয়াজ তুলেছি। হাজার লক্ষ গলার সঙ্গে গলা মিলিয়েছি। প্রতিবাদ করেছি। লড়াকু কলকাতার আগুনে আমিও উত্তপ্ত হয়েছি। ঊনিশশো ঊনপঞ্চাশের কলকাতার কথা মনে পড়ছে। প্রেসিডেন্সি, আলিপুর আর দমদম সেন্ট্রাল জেল গিজগিজ করছে প্রতিবাদী মানুষের ভিড়ে। বেহিসেবি গুলি আর লাঠি চলছে ভেতরে, বাইরে। এলোপাথাড়ি গুলি, বেপরোয়া লাঠি। আর ওই অসহ্য পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে এগিয়ে আসছে কলকাতার মানুষ, গ্রামের কৃষক, শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক। এগিয়ে আসছে মেয়ে, পুরুষ, ছেলে, বুড়ো- সবাই। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আর সন্ত্রাসের সংঘর্ষ। …আমরা কয়েকজন বন্ধু ও আমি তখন ছবির রাজ্যে ঢোকবার আপ্রাণ চেষ্টা করছি।” ‘চলচ্চিত্রের ভূত-বর্তমান-ভবিষৎ’ বইতে এমনটাই তিনি লিখে গেছেন। একটা সময়কাল। শহরের এক অবিচ্ছিন্ন প্রতিরূপ।
“ছবির রাজ্যে ঢোকার চেষ্টা” থেকে “ছবির রাজ্যে ঢুকে যাওয়া” ইস্তক মৃণালবাবু আপ্রাণ লড়াই করেছিলেন মানুষের কাছে পৌঁছে তাঁদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সত্তাগুলোকে, চেতনাগুলোকে সিনেমার মাধ্যমে জারিত করতে। প্রাক-‘ভুবন সোম’ ও ‘ভুবন সোম’ পরবর্তী অধ্যায় থেকে সিনেমাকে ছুটি দেবার সময় অবধি মৃণালবাবু অনেকটাই পরিবর্তিত, অনেক প্রত্যক্ষ, প্রতিবাদী ও সাহসী। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে তিনিই সম্ভবত প্রথম, যিনি চিরাচরিত প্রথাগত  ‘মেকিং’ থেকে বেরিয়ে গিয়ে এক নতুন ধারাকে আলিঙ্গন করেছিলেন। তাঁর কথায়, একটা সময় ছিল যখন তিনি অনুভব করতেন বড় শহরের ভিড়ে হারিয়ে যাবার ভয়— “শূন্যতার বিষণ্ণ অনুভূতিতে তীব্রভাবে ভুগছি। যতক্ষণ না জিনিসগুলি ভিন্ন প্রমাণিত হয়”। হয়তো, সেই নিঃসঙ্গ সৈনিক সেই ভিন্ন সিনেমার মুক্তি খুঁজেছিলেন একান্ত নিজের অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ দিয়ে। 
পঞ্চাশ বছর আগের কলকাতায় ছাপাখানার মেশিনে খবরের হেডলাইন আজ রোমহর্ষক লাগে। বড়ই সংবেদনশীল। যে কলকাতা মৃণালবাবুকে কাঁদাতো, হাসাতো, ভাবাতো, হতাশ করতো, অনুপ্রাণিত করতো, তিয়াত্তরের ‘পদাতিক’-এর প্রথম দৃশ্যের প্রথম মন্তাজে চলমান প্রেস মেশিনের থেকে নিংড়ে আনা সংবাদ প্রবাহের বদলে যাওয়া হেডলাইনস তাঁর এই অনুভূতিগলোকে দর্শকদের কাছে ধরিয়ে দিয়ে যায়।
“দারিদ্র ও বেকারির চাপে দেশের মানুষ জর্জরিত”। “দেশের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে”। “দ্রব্যমূল্যের ভয়াবহ বৃদ্ধি”। “কালোবাজারি, মুনফাবাজ ও মজুতদারির অবাধ রাজত্ব”। “কেরোসিন তেল বাজার থেকে উধাও”। “ব্যাপক অভিযানের ফলে হাজার হাজার ভুয়ো রেশন কার্ড উদ্ধার”। “ক্ষুধার তাড়নায় তরুণ দম্পতির আত্মহত্যা”। “গ্রামাঞ্চলে অনাহারে মৃত্যুর খবর”।  “রাজনৈতিক দলগুলোতে ক্রমবর্ধমান অন্তর্দ্বন্দ্ব”। “পরীক্ষা ভন্ডুল”। “আইন শৃঙ্খলা স্থাপনে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ”।“অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীনে সরকারের ভূমিকা”। “রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান ঘটাতে সরকার বদ্ধপরিকর”। “দিকে দিকে পালটা শ্রমিক ইউনিয়ন”। “শ্রমিক অঞ্চলে ক্রমাগত দলীয় সংঘর্ষ”। “সমস্যা সঙ্কুল মহানগরী”। ইত্যাদি। 
সমকালীন পটভূমি কি অন্য কোনও নতুন কাহিনি লিখতে পেরেছে? পারেনি বলেই মৃণাল সেন যুক্তিবাদী, বিশ্লেষক, দূরদর্শী ও সমকালীন। 
‘প্রত্যয়’ যে কোনও ধরনের রাজনৈতিক সিনেমার এক বিশেষ প্রয়োজনীয়তা, বিশেষ করে যা সমাজের অন্তর্নিহিত সত্যিগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করার দাবি জানায়। সত্যজিত রায় এবং ঋত্বিক ঘটক সহ পরিচালক-ত্রয়ীর মধ্যে মৃণাল সেন ছিলেন সবচেয়ে র্যাজডিকাল, বামপন্থী মতাদর্শের মধ্যে নিজের সৃষ্টিশীল পৃথিবী তৈরি করেছিলেন। সিনেমার ভাষা প্রয়োগে ফরাসি নবতরঙ্গ তাঁকে কিছুটা প্রভাবিত করেছিল, বিশেষ করে, প্রথাবরোধী ছবি করার ক্ষেত্রে। রায় এবং ঘটকের মহাকাব্যিক ঐতিহ্যের ধ্রুপদী শৈলীর বিপরীতে মৃণাল সেন তাঁর চলচ্চিত্রের মতাদর্শগত বিষয়বস্তু সম্পর্কে একনিষ্ঠ ছিলেন। ‘ইন্টারভিউ’ সিনেমায় কোর্টঘরের প্রতীকী দৃশ্য একসাথে অনেক অব্যক্ত কথার প্রকাশ ঘটিয়ে যায়। ‘কলকাতা ৭১’-এর শুরুতে ‘‘হাজার বছর ধরে, আমি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আসছি: দারিদ্রের, অভাবের, নিপীড়নের ইতিহাস,’’ যেখানে ‘‘আমি’’ প্রতীকীর কলকাতা শহর। দৃঢ় অথচ জনশূন্য শহরের এই থিম এবং মোটিফটি তাঁর অনেক চলচ্চিত্রে বারবার দেখা যায়, প্রায়শই হরতাল, রাস্তার প্রতিবাদ, ভিয়েতনাম যুদ্ধের ডকুমেন্টারি ফুটেজ বা বিজ্ঞাপন এবং বিলবোর্ডের সাথে বিপরীত সংবাদের ক্লিপিংয়ের মন্তাজের সাথে মিলিত হয়। প্রাসঙ্গিক পরিবেশ এবং এর রাজনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে একটি সহজবোধ্য উপলব্ধি জানিয়ে দিয়ে যায়।
মৃণাল সেন বিশ্বাস করতেন, তিনি ঘটনাক্রমে চলচ্চিত্রের একজন নির্মাতা হয়েছিলেন। তাঁর শহর, নির্দয়ভাবে অপদস্থ এবং বিপজ্জনকভাবে প্রিয়, এটা তাঁর মন। ‘ভালো বা খারাপ’, ‘হ্যাঁ বা না’, অনেকেই তাঁকে ‘আইকনোক্লাস্ট’ হিসাবে জেনেছে। অনেকেই মনে করতেন, মৃণালবাবুর মতে, তিনি প্রতিষ্ঠানবিরোধী ও প্রতিবাদী, প্রথাবিরোধী একজন রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন চলচ্চিত্র পরিচালক। মৃণাল সেনের প্রথম পছন্দের ছবি ছিল চার্লি চ্যাপলিনের নির্মিত ছবিগুলো। তখন মৃণালবাবুর ছেলেবেলা। বয়স বছর নয়েক। চার্লি চ্যাপলিন অভিনীত ‘দ্য কিড’ (১৯২১) দেখে তিনি ‘হাসলেন’ আর ‘হাসলেন’। চার্লির ছবিতে হাস্যরসের নেপথ্যে আঁকা প্রান্তিক মানুষের চিত্রায়িত বেদনা, হতাশা এবং জীবন অভিমুখী উত্তরণের স্বপ্নিল উড়ান নিঃসন্দেহে শৈশবের মৃণাল সেনকে আবিষ্ট করেছিল, সন্দেহ নেই। অনেক অনেক দিন পরে, ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ‘কলকাতা ৭১’ প্রদর্শনের সময়ে মৃণালবাবুর কথা বলার সুযোগ হয়েছিল চার্লির সাথে। তিনি চার্লিকে বলেছিলেন– ‘আপনার ছবি দেখে আমি জ্ঞানী হয়েছি’। 
১৯৮৬-র কলকাতায় মৃণালবাবুর ওপর তথ্যচিত্র করতে এসেছিলেন জার্মান চলচ্চিত্র নির্মাতা রেইনহার্ড হফ। কলকাতায় দশ দিনের মৃণাল সেনের দিনকাল। হফ মৃণালবাবুর ওপর উদ্দেশ্যমূলক বা জীবনীভিত্তিক কোনও তথ্যচিত্র তৈরি করেননি। পরিবর্তে, তিনি কলকাতা এবং মৃণাল সেনের মধ্যে তাঁর মনোযোগ ব্যক্ত করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। তথ্যচিত্রটিতে একটি শহরের সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে হফের ধারণা এবং মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রে যেমনভাবে সেগুলো চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে, তার মধ্যে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করেছিলেন। একজন ফিল্মমেকারের চোখে, যিনি শহরের প্রতি গভীরভাবে দায়বদ্ধ, এমন একটি শহর যা সেনের মনে এবং আরও অনেকের মনে তীব্র প্রেম এবং ঘৃণা জাগিয়ে তোলে।  শহরের প্রতি মৃণাল সেনের দৃষ্টিভঙ্গি, অভ্যন্তরীণ এবং বাইরের বাস্তবতা সন্ধান করতে চেয়েছিলেন, এমন একটি পদ্ধতি যা হফ ‘ক্রিটিকাল রিয়ালিটি’ হিসাবে বর্ণনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মৃণাল সেনের জীবনের মাত্র দশ দিনের সারসংক্ষেপ কি তাঁর সিনেমার জার্নিকে পরিপূর্ণ করতে পেরেছিল? কারণ মৃণাল সেন তো ‘হাজার বছর ধরে’  ইতিহাসের সাক্ষী থেকে গেছেন— দারিদ্রের, অভাবের, নিপীড়নের ইতিহাসের ‘সাক্ষী’!
বাহান্ন বছর আগে মৃণাল সেনের বয়স ছিল আটচল্লিশ। ১৯৭১-এর মৃণাল সেনকে ভাবা যাক। ঠিক তার আগের তিনটি বছর সিনেমাকে নিয়ে নতুনভাবে প্রকাশ করার আকাশ কুসুম ভাবনাকে এক পূর্ণতা এনে দিয়েছে। ভারতীয় ছবির জগতে বেশ হই চই ফেলে দিয়েছে তাঁর ‘ভুবন সোম’। সত্যজিৎ রায়ের ১৯৫৫-র ক্লাসিক ‘পথের পাঁচালি’ যদি দেশীয় নব্য-বাস্তবতাবাদী সিনেমার একটা ল্যান্ডমার্ক হয়, ১৯৬৯-এর মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’ আধুনিক ভারতীয় নবতরঙ্গ সিনেমার নিঃসন্দেহে আর এক ল্যান্ডমার্ক। ‘পথের পাঁচালি’-র পরের বছরগুলোতে বাংলার দর্শকরা বেশ কিছু ভালো সিনেমা পেয়েছে, সত্যজিতের প্রতি বছর একের পর এক ক্লাসিক, ঋত্বিকের দেশভাগের যন্ত্রণার নির্যাসে তৈরি হৃদয়-উজাড় করা সমকালীন ভাবাবেগের প্রতিচ্ছবি। একই সিনেমা-নৌকোয় পাড়ি দেওয়া মৃণাল সেন তবু স্বতন্ত্র। কোনও সাজানো পরম্পরা নয়, নব্যবাস্তব গল্প-বিন্যাস নয়, মৃণাল সেন পথ দেখিয়েছিলেন ‘সিনেমা এমনভাবেও হয়’!  ষাট দশকের শেষে আন্তর্জাতিক সিনেমার চিরাচরিত ভাষা তো ভেঙেচুরে গেছে। নিও-রিয়্যালিস্ট ছবিগুলোর নিজস্ব চরিত্র তো বদলেছেই, সাথে সিনে-ব্যাকরণকে ভাসিয়ে দিয়েছে মাত্র তার বছর দশেক আগের ফরাসি নবতরঙ্গের ঢেউ। এমন স্বাধীনভাবে রূঢ় সত্য স্পষ্টভাবে পার্সোনালাইজড অনুভূতিতে ব্যক্ত করার সিনেম্যাটিক স্পর্ধা মৃণাল সেনেরই হাত ধরে ভারতীয় সিনেমায় এসেছিল। 
একসাথে তিনটি তিন ধারার ছবি প্রযোজনা করেছিল ফিল্ম ফিনান্স কর্পোরেশন। ১৯৬৮। মণি কাউল করেছিলেন ‘উসকি রোটি’, বাসু চ্যাটার্জি করেছিলেন ‘সারা আকাশ’ আর মৃণাল সেন তাঁর কাল-অতিক্রমী ছবি ‘ভুবন সোম’। সিনেমা ভাষা ভাঙার কাজ প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল সে বছর থেকেই। মুক্ত মনে নিজের ভাবনা অনুযায়ী সিনেমা সাজানোর সৌজন্যে ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমাধারা। মৃণালবাবু একটু পরে আরও নতুন কিছু ভাবছিলেন। এমন কিছু যা ভারতীয় ছবির ফর্মের দিক থেকে নতুনত্ব আনবে, বৈচিত্র আনবে। যেমন ব্যাকরণ-ভাঙা কাজে বছর পঁচিশ আগে ফরাসি সিনেমায় পথ দেখিয়েছিল ‘কাইয়ে দ্যু সিনেমা’র প্রতিবাদী সদস্যগোষ্ঠী- জাঁ লুক গদার, ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, জ্যাক রিভেটদের হাত ধরে। সমাজ আলাদা, রাজনীতি আলাদা, অর্থনীতি বা সাংস্কৃতিক পৃথিবীও আলাদা। কিন্তু সিনেমার ভাষা তো সর্বজনীন, সময়ের হাত ধরে পায়ে পায়ে এগিয়েছে, ভেঙেছে, নতুন ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে সিনেমাকারদের শিল্পরূপ। কমিউনিকেশনের আধারটাকে উলটেপালটে নেড়েচেড়ে দেখার একটা চেষ্টা। এই প্রক্রিয়াটাও যে একটা কমিউনিকেটিভ ন্যারেটিভ স্টাইল হতে পারে, ভারতীয় সিনেমায় সেই সাহস প্রথম দেখালেন মৃণাল সেন। কোনও অতিবাস্তবতা নেই, সোজাসুজি গল্পবিন্যাস নেই, সরাসরি বক্তব্য দর্শকদের সরাসরি বলা, সরাসরি ভণিতাহীন রাজনৈতিক অবস্থা ও অবস্থান, কোলাজধর্মী অনেক কথা প্রকাশ করার সুষম সমাহারে এই সত্তর দশকেই আবার নিজেকে ভাঙলেন মৃণাল সেন। তাঁর কলকাতা- ত্রয়ী সিরিজেই তিনি তৈরি করলেন নতুন এক কাঠামোহীন ন্যারেটিভ- যা একান্তভাবেই বৈপ্লবিক, যা একান্তভাবেই মৃণাল সেনীয়। এর জন্যই ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ ম্যাগাজিনে সমালোচক ডেরেক ম্যালকমের নেওয়া মৃণাল সেনের সাক্ষাৎকারে শীর্ষকে লিখেছিলেন ‘দ্য গেরিলা ফাইটার’।  
আধুনিক পৃথিবীও অনেকটাই বদলে গেছে, বদলে গেছে বাংলার তিন সিনেমা দিকপালের মননের বসুন্ধরা। সত্যজিৎ ডি সিকা-জাভাত্তিনির নিও-রিয়্যালিস্ট পথ প্রদর্শিত নব্য-বাস্তবদাবাদী ছবির পরিভাষাকেই প্রকাশ করেছেন তাঁর ছবির মধ্যে দিয়ে, যদিও 'অরণ্যের দিনরাত্রি' পরবর্তীকালে ছবির বিষয়-ভাবনায়  সমকালীনতা এনেছিলেন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, সীমাবদ্ধ’ ‘জন অরণ্য’-র মাধ্যমে। '৭০ দশকের বাঙালি  যুব-সম্প্রদায় রাজনৈতিক অস্থিরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। ফুঁসছে রাজনীতি। ছাত্রসমাজ। কায়িক চাকরিকারীরা, শহরতলির শ্রমিকশ্রেণি। বামপন্থার মনন খুব স্বাভাবিক ছন্দেই আলিঙ্গন করে নিয়েছিলেন শহরবাসী, তাঁদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার চিন্তা-সাথী করে। 
‘ইন্টারভিউ’ ছবিতে অভিনেতা হিসাবে রঞ্জিত মল্লিকের আত্মপ্রকাশ ছবির প্রোটাগনিস্ট রঞ্জিত মল্লিকেরই মাধ্যমে। ভিড় বাসে সরাসরি ক্যামরাকে নিজের নাম জানিয়ে বর্ণিত করছেন মধ্যবিত্ত এক বেকার ছেলের চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবার স্বতঃস্ফূর্ততা। সে সময়ের দেশীয় সিনেমায় এক নতুন মাত্রা। নতুন বার্তাও বটে। ‘সিনেমা ভেরিতে’ বা ডাইরেক্ট সিনেমা যা লাতিন আমেরিকান বা কিছু অ্যাফ্রো-এশীয় দেশগুলোতে রাজনৈতিক সিনেমা বিন্যাসের ক্ষেত্রে এক নতুন সফল সিনেম্যাটিক ধারার সৃষ্টি করেছিল, সেদিনের মৃণাল সেন কলকাতা-বিষয়ক ত্রিধারার মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন। সঙ্গে নিউ ওয়েভ সিনেমার জাম্প কাটের ব্যবহারিক প্রয়োগ আর সময় ও ক্ষেত্র নির্ধারণের বিভিন্নতা। ইন্টারভিউ দিতে যাবার প্রাক্কালে রঞ্জিত তার স্যুট ট্রাউজার ইস্ত্রি পরিপাটির দোকান থেকে আনতে গিয়ে দেখলো শ্রমিক ধর্মঘটের জন্য সেদিন বন্ধ। বিস্তর টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে অবশেষে রঞ্জিত মনস্থির করলো সে সাবেক পরিচ্ছদ ধুতি পাঞ্জাবি পড়েই ইন্টারভিউ দিতে যাবে। সাধারণ ঘটনা, কিন্তু অসাধারণ উপস্থাপনায় জীবন্ত জ্বলন্ত সমস্যার পিছনে ক্যামেরা সচল রেখেছিলেন মৃণাল।
সত্যজিতের ‘তিন কন্যা’ তিনটি ভিন্নধর্মীয় রাবীন্দ্রিক গল্পের সমাহারে এমন এক সম্পূর্ণ কাহিনিচিত্র যা প্রায়োগিক মৌলিকতা এনেছিল বাংলা ছবিতে। মৃণালের ‘কলকাতা ৭১’ সেজেছিল এমন চারটি ভিন্ন গল্পের সমাহারে। ভিন্ন গল্প। ভিন্ন পরিসর। কিন্তু একটা সম্পূর্ণতা ছিল বিষয়বস্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প দিয়ে শুরু, দ্বিতীয়টা প্রবোধ স্যান্যালের ‘অঙ্গার’ গল্প অবলম্বনে, পরের দুটি সমরেশ বসু ও অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় বিরচিত। গল্প না বলে ঘটনার পর্যায়ক্রম বলা যায়। চার কাহিনির সমাবেশে পূর্ণতা পেয়েছিল নকশালপন্থী আন্দোলন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ছাত্র-যুব আন্দোলন, ক্ষুধার রাজ্যের পৃথিবী, বেকারত্ব, উদ্বাস্তু সমস্যা, উচ্চবিত্তের নিস্পৃহতা, অসহায়তা আর মুক্তি কামনায় মানুষের এক গতিময় লড়াই। 
কলকাতা-ত্রয়ী ছবির শেষ ছবি ‘পদাতিক’। ১৯৭৩। বামপন্থী রাজনৈতিক চেতনাকে নিষ্ক্রিয় করতে উল্লাসী রাজনীতির চাপে কোণঠাসা কমিউনিস্টদের প্রেক্ষিত ও চরিত্রকে নিয়ে সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক ছবি ‘পদাতিক’। সেই জায়গা থেকে প্রোটাগনিস্ট চরিত্র সুমিত এক নতুন বোধের ব্যাপ্তি খুঁজতে চাইছিল যেখানে সে নতুনভাবে মূল্যায়ন করতে চাইছিল সমকালীন কলকাতার বামপন্থী আন্দোলনকে, সমাজ, শহর ও মূল্যবোধকে। অর্থাৎ, এই তিন রাজনৈতিক ছবি করতে গিয়ে মৃণাল সেন নিজের চলচ্চিত্র ছন্দ নতুন আঙ্গিকে সাজালেন। 
কলকাতার মধ্যে একটা ভাইব্রেন্সি খুঁজে পেয়েছিলেন মৃণালবাবু। একটা স্পিরিট। একটা ফোর্স। একাত্তরের কলকাতা তাঁকে সেই রসদ জুগিয়েছিল। তাই মৃণাল সেন শহরের প্রতি দায়বদ্ধতা খুঁজে পেয়েছিলেন সমাজ ও রাজনৈতিক বৈচিত্রের মধ্যে। রোম্যান্টিক রাজনৈতিক আশ্রয় এড়ানো চিরকালীন সেই কলকাতাকেই খুঁজে বেড়িয়েছিলেন সমকালীন শহরবৃত্তের মধ্যে। কলকাতা-ত্রয়ী সিরিজের পর পঞ্চাশ বছরের মৃণালের সেই রচিত ও গ্রথিত কলকাতা আজও আছে সেই কলকাতাতেই। 
সিনেস্টেট ম্যাগাজিনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি সমাদর করেছিলেন এম এস সথ্যুর ‘গরম হাওয়া’ ছবিটির। শ্যাম বেনেগালের ‘অঙ্কুর’। মৃণাল সেনের সিনেমা-ধারণা নিজের অজান্তেই পরবর্তী সমান্তরাল ভারতীয় সিনেমা পরিচালকদের অনেকের কাছেই সৃজনশীলতার উৎস। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রতিচ্ছবি ছিল সথ্যুর ‘গরম হাওয়া’-য়। সিনেমাটিকে নিয়ে মৃণালবাবু দরাজ ছিলেন। আজ বোঝা যায়, যেমন তাঁর ছবিতে ‘সমকালীন’ কলকাতা একইভাবে অনেক প্রশ্নের উত্তর খুজছে, সথ্যুর ‘গরম হাওয়া’-ও কী আশ্চর্যভাবে আজও সমকালীন। রাজনৈতিক দূরদর্শী এমন না হলে রাজনৈতিক ছবি করেছেন কীভাবে?
মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রে সিনেমাটিক ইমোশানস সুপ্তভাবেই ব্যাখ্যায়িত। পুত্র কুণাল সেন এক সাক্ষাৎকারে একটি ঘটনার কথা বলেছিলেন। নিমতলা শ্মশানঘাটে ১৯৪১-এর রবি-প্রয়াণের অগ্নিদাহে অষ্টাদশের যুবক মৃণাল সেন দেখেছিলেন ভিড়ে-ঠাসা রবীন্দ্র-চিতার পাশে দাহ করার জন্য এক টুকরো আগুনের অসাধ্য প্রচেষ্টায় সন্তান-হারা এক পিতার বুক-ভরা কান্না আর হাহাকার। সে দৃশ্য হৃদয়মাঝে ঠাঁই দিয়েছিলেন তিনি।  বুঝেছিলেন— সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদের সমস্যা বা যন্ত্রণা অনেক গভীরের— সেখানে রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিত্বের মৃত্যুক্ষণও খড়কুটোর মতো উড়ে যায়। অনেক পরে, সেই ‘বাইশে শ্রাবণ’-এ ফিরে আসে—  রবীন্দ্র-মৃত্যুর দিনে আশা নিয়ে ঘর বেঁধেছিল ছবিটির দুই দুঃস্থ, বিধ্বস্ত চরিত্রেরা। ‘আকালের সন্ধানে’ ছবিটিতে সেই আবেগ রামধনুর সাতটি রঙে যেন ছড়িয়ে দিয়ে যায়– ‘হেঁই সামলো ধান হো’ গানের উদাত্ত ব্যাপ্তিতে। বিশ্বাসী মন ভেঙে যায় ‘মহাপৃথিবী’-তে বার্লিন প্রাচীর ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণার হা-হুতাশের শহরের এক পরিবারের চিত্রায়নে। রাজনৈতিক আবেগে নিজেকে জারিত করে  উত্তরণের উন্নততর সমাজের স্বপ্নের যে আবেগ তাঁকে অনুপ্রাণিত করে এসেছে চিরকাল– তাঁর রাজনৈতিক চেতনাবৃদ্ধির সেই দিনগুলো যখন তিনি পেরিয়েছিলেন হাজরা মোড়ের প্যারাডাইস কাফে থেকে গণনাট্যের অমোঘ শিল্প-সঞ্চারণে।
মৃণাল সেন নিজেকে বারবার ভেঙেছেন। গড়েছেনও বারবার। সময়ের সাথেই তিনি পেরিয়ে যাচ্ছেন শতবর্ষ। এই তো! মাত্র তেরো বছর আগে মৃণালবাবু জীবনের শেষবারের মতো কান চলচ্চিত্র উৎসবের প্যালাই থিয়েটারের মঞ্চে উঠেছিলেন। শেষবার। চোখের সামনে এক অভূতপূর্ব সম্মান চাক্ষুষ করলেন। পরিপূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে হাজারো করতালির মাঝে মঞ্চে উপবিষ্ট বৃদ্ধ মৃণাল সেন। এই সেই মঞ্চ যেখানে একইভাবে সম্মানিত হয়েছিলেন জাঁ রেনোয়াঁ, লুই বুনুয়েল, লুচিনো ভিসকোন্তি, ভল্কার স্ক্লোনডর্ফ. জন হাস্টন, অ্যালফ্রেড  
হিচককের মতো সিনেমা পথিকৃতেরা। 
শতবর্ষের শুরুর দিনগুলোতে আমরাও মৃণাল সেনের সাথে সেই মিছিলে হাঁটছি, যেটা হাজার বছর ধরে পথ চলার ক্লান্তহীন যাত্রা করছে– অন্যায়, দারিদ্র, প্রবঞ্চনা থেকে মানুষের উত্তরণের সেই স্বপ্নমিছিল। স্বতঃস্ফূর্ততায় ভরা প্রতিবাদ।
ফেলিনির সেই উক্তিকে মান্যতা দিতেই হয়– “শেষ নেই। কোনও শুরু নেই। আছে শুধু জীবনের আবেগ”…

Comments :0

Login to leave a comment