অঞ্জন বেরা
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল পূর্ণ স্বরাজ বা স্বাধীনতার পক্ষে জাতীয় কংগ্রেসের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে অবিভক্ত ভারতের লাহোর শহরে জওহরলাল নেহরুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত চুয়াল্লিশতম অধিবেশনে (২৬ ডিসেম্বর ১৯২৯- ১ জানুয়ারি ১৯৩০) জাতীয় কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম এই মর্মে প্রস্তাব গ্রহণ করে। ২৭ ডিসেম্বর গান্ধীজী লাহোর অধিবেশনে সাবজেক্ট কমিটির বৈঠকে পূর্ণ স্বরাজের প্রস্তাব পেশ করেন। ২৯ ডিসেম্বর জওহরলাল নেহরু তাঁর সভাপতির ভাষণে ঔপনিবেশিক শাসন মুক্তিকেই তার লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করেন। ৩১ ডিসেম্বর কংগ্রেসের প্রকাশ্য অধিবেশনে সেই প্রস্তাব গৃহীত হয়। আজ থেকে ৯৫ বছর আগে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকের মুখে কংগ্রেসের এই সিদ্ধান্ত জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে নতুন পর্বের সূচনা করে। সমগ্র জাতির আকাঙ্খার বহুস্তরীয় প্রতিফলন পড়ে লাহোরের প্রস্তাবে।
জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার আগে ভারতীয় উপমহাদেশে দাদাভাই নওরোজি-ই প্রথম ভারতীয় হিসেবে ব্রিটিশ শাসনের শোষণমূলক চরিত্রের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বৈশিষ্ঠ্যের ব্যাখ্যা দেন। নরমপন্থী হিসাবে পরিচিত দাদাভাই নওরোজি নিজে কখনও পূর্ণ স্বরাজের দাবি তোলেননি। কিন্তু শোষণমূলক ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে হলে যে ঔপনিবেশিক জমানার অবসান চাই এই যুক্তি তাঁর ব্যাখ্যা থেকেই প্রতিষ্ঠা করা যায়।
ভারতের ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী সংগ্রাম নতুন পর্বে প্রবেশ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) পর। সাম্রাজ্যবাদী সেই যুদ্ধের মধ্যেই ১৯১৭ সালে লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্য বিশ্ব রাজনীতির শক্তি ভারসাম্যে বদল আনে। ১৯১৯ সালে লেনিনের উদ্যোগে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের প্রতিষ্ঠা। ১৯২০ সালে প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের হাতে গঠিত হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে গুজরাটের আহমেদাবাদে জাতীয় কংগ্রেসের ৩৬-তম অধিবেশনে এমএন রায় এবং অবনী মুখার্জির নামে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ইশ্তেহার প্রচারিত হয়। মৌলানা হজরত মোহানী এবং স্বামী কুমারানন্দ কংগ্রেস অধিবেশনে কমিউনিস্ট পার্টির নামে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’র পক্ষে দাবি উত্থাপন করেন। যদিও সেই প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। স্বয়ং গান্ধীজী সেই প্রচেষ্টায় আপত্তি জানান। প্রস্তাব অনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত না হলেও আহমেদাবাদ অধিবেশনেই কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে জাতীয় কংগ্রেসের উদ্দেশ্যে প্রথম কোনও প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। আহমেদাবাদের পর গোটা ১৯২০-র দশক জুড়ে সিপিআই জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে দাবি উত্থাপন করে গেছে। কমিউনিস্ট পার্টি স্বাভাবিকভাবেই জন্মলগ্ন থেকেই ঔপনিবেশিক জমানার উৎখাত দাবি করে। ভারতীয় জনগণ এবং ঔপনিবেশিক জমানার দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি না ঘটিয়ে যে পরিস্থিতির মৌলিক রূপান্তর অসম্ভব এই স্বাভাবিক উপলব্ধির প্রশ্নে কোনও সমঝোতা কমিউনিস্টদের পক্ষে ছিল অসম্ভব।
পরিস্থিতির খাতিরে বিশের দশকের শেষ দিকে পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে জোরালো দাবি উঠতে শুরু করে কংগ্রেসের মঞ্চে। শ্রমিক কৃষক ছাত্র যুবদের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণে রাজনৈতিক পরিসরে নতুন উপাদান যুক্ত হয়। বিশের দশকের শেষ দিকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা সাম্রাজ্যবাদী-ঔপনিবেশিক শক্তিকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেয়। উপনিবেশগুলিতে জোরালো হয়ে উঠে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন। সাইমন কমিশন বিরোধী সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে ১৯২৮ সালের ২১-২৪ ডিসেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় অল ইন্ডিয়া ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজ্যান্টস পার্টির প্রথম সর্বভারতীয় সম্মেলন। কমিনিস্টরাই ছিল এই দলের প্রাণশক্তি। প্রথম সম্মেলনেই ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে দাবি জানায় অল ইন্ডিয়া ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজ্যান্টস পার্টি ।
১৯২৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে ১ জানুয়ারি (১৯২৯) কলকাতায় পন্ডিত মতিলাল নেহরুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রের ৪৩-তম অধিবেশন কংগ্রেসের তরুণ নেতৃত্ব পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার হন। কিন্তু কলকাতা অধিবেশনেও তাঁরা সফল হননি। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতির বদল ঘটে লাহোরে।
লাহোর অধিবেশনে সিদ্ধান্ত হয় জাতীয় কংগ্রেস ১৯৩০-র ২৬ জানুয়ারি দেশজুড়ে পূর্ণ স্বরাজ দিবস পালন করবে। সরকারী দমনপীড়ন সত্ত্বেও তা পালিত হয়। সর্বত্র কংগ্রেসের নেতৃত্বে কংগ্রেসের পতাকা উত্তোলিত হয়।
লাহোর অধিবেশনের আগেই ১৯২৯ সালে-র ২০ মার্চ দেশব্যাপী ব্যাপক ধরপাকড় নেমে আসে কমিউনিস্টদের উপর। গান্ধীজী মীরাটে কারাগারে গিয়ে বন্দিদের সঙ্গে দেখা করেন। মতিলাল নেহরু এ জওহরলাল নেহেরু মীরাট বন্দিদের পাশে দাঁড়ান। বলাবাহুল্য, মীরাট মামলায় অভিযুক্ত কমিউনিস্ট ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা তাঁদের বিবৃতিতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের জোরালো দাবি জানান। কমিউনিস্টরা জাতীয় কংগ্রেসের আরও জঙ্গি ভূমিকা দাবি করে। ১৯৩০ সালের ১৬ ডিসেম্বর কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের মুখপত্র ইনপ্রেকর-এসিপিআই’র ‘ড্রাফট প্ল্যাটফর্ম অব অ্যাকশান’ প্রকাশিত হয়। স্বভাবতই মীরটা বন্দিদের বক্তব্য এবং ‘ড্রাফট প্ল্যাটফর্ম অব অ্যাকশান’ বৈপ্লবিক রূপান্তরের পক্ষেই সরব হয়।
জাতীয় কংগ্রেস অবশ্য পূর্ণ স্বরাজ দিবস উদ্যাপনের পরই আইন অমান্য আন্দোলনে নেমে পড়ে, বিশেষত গান্ধীজীর নেতৃত্বে লবণ সত্যাগ্রহ ছিল উল্লেখযোগ্য। আইনসভাগুলিও কংগ্রেস বয়কটের ডাক দেয়।
সশস্ত্র বিপ্লবীরাও সক্রিয় হয়ে উঠে। ১৯২৯ সালের এপ্রিলে ভগৎ সিং ও তাঁর সহযোদ্ধারা দিল্লিতে সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেমব্লিতে বোমা নিক্ষেপ করে। তাঁরা গ্রেপ্তার হন। শেষ পর্যন্ত তাঁদের ফাঁসি হয়। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামে মাস্টারদার নেতৃত্বে আক্রমণ চালানো হয় সরকারি অস্ত্রাগারে।
এরকম প্রেক্ষাপটে করাচি শহরে ১৯৩১ সালের ২৬-৩১ মার্চ সর্দার বল্লবভাই প্যাটেলের সভাপতিত্ব অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় কংগ্রেসের ৪৫তম অধিবেশন। করাচি অধিবেশনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল মৌলিক অধিকার সমূহ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচি বিষয়ক প্রস্তাব গৃহীত হয়। গুরুত্বপূর্ণ এই প্রস্তাবে বলা হয়:‘কংগ্রেসের এই অধিবেশন মনে করে যে, কংগ্রেস-পরিকল্পিত ‘স্বরাজ’ তাদের জন্য কী অর্থ বহন করবে তা সহজবোধ্যভাবে তুলে ধরা বাঞ্ছনীয়। জনসাধারণের শোষণ অবসানের লক্ষ্যে রাজনৈতিক স্বাধীনতার মধ্যে অনাহারী কোটি কোটি মানুষের প্রকৃত অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে।’ (‘ইন অর্ডার টু এন্ড দি এক্সপ্লয়টেশন অব দি মাসেস, পলিটিক্যাল ফ্রিডম মাস্ট ইনক্লুড রিয়াল ইকনমিক ফ্রিডম অব দি স্টর্ভিং মিলিয়নস’।)
৪৫-তম কংগ্রেস অধিবেশনে গৃহীত চোদ্দ দফা মৌলিক অধিকারের নবম দফায় বলা হয়, স্বাধীন দেশে ‘সমস্ত ধর্মের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নিরপেক্ষ থাকবে।’ (‘দি স্টেট শ্যাল অবজারভ নিউট্রালিটি ইন রিগার্ড টু অল রিলিজিয়ানস’।)
প্রসঙ্গত, ১৯৩২ সালের ৪ জানুয়ারি জাতীয় কংগ্রেস নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। কার্যত নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৩৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বেআইনি ঘোষিত হয়। নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল ১৯৪২ সাল পর্যন্ত।
বিশের দশক থেকে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ক্রম রূপান্তরের প্রেক্ষাপটে উত্থান ঘটছিল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির। সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু উভয় সাম্প্রদায়িক শক্তির। ১৯৩০-র দশকের গোড়ায় রাউন্ড টেবল কনফারেন্সের প্রেক্ষাপটে জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লিগ সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির পালে বাতাস জোগায়। ১৯৩৪ সালে বিলেতবাসী জিন্নাহ বোম্বে থেকে কেন্দ্রীয় আইনসভায় নির্বাচিত হয়ে ভারতে ফিরে আসেন।
১৯২০-দশক থেকে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলিও সংগঠিত ও পরিকল্পিত ভাবে রাজনৈতিক পরিসরের দখল নিতে শুরু করে। ‘অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা’ (প্রতিষ্ঠা ১৯১৫) আন্ত-প্রাদেশিক তৎপরতা বাড়ায় বিশের দশক থেকে। ১৯২৫ সালে ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ’(আরএসএস) নাগপুরে আত্মপ্রকাশ করে কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের (১৮৮৯-১৯৪০) নেতৃত্বে। আরএসএস পরিচয় দেয় ‘সাংস্কৃতিক’ সংগঠন হিসাবে। বিনায়ক দামোদর সাভারকর (১৮৮৩-১৯৬৬) আন্দামান থেকে ১৯২৪ সালে ছাড়া পাওয়ার পর হিন্দু মহাসভাকে রাজনৈতিক দলের রূপ দিলেও কালক্রমে স্বাধীনতার পর আরএসএস-ই ‘হিন্দুত্ব’বাদীদের প্রধান মঞ্চ। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর সঙ্ঘ পরিবারের পরিকল্পনা মাফিক প্রথমে জনসঙ্ঘ (১৯৫১) এবং তারপর ভারতীয় জনতা পার্টি (১৯৮০) গঠিত হয়। চলতি বছরে আরএসএস’র শতবর্ষ উদ্যাপন শুরু হয়েছে মহাসমারোহে। ২০১৪ সাল থেকে কেন্দ্রে মোদী সরকারের অবস্থান এবং কর্পোরেট মদতপুষ্ট হিন্দুত্ব রাজনীতির আগ্রাসী প্রসার এমনকি প্রশাসনের সর্বস্তরেও সঙ্ঘ পরিবারের প্রভাব বাড়িয়ে চলেছে। আরএসএস’র শতবর্ষ পালনে রাষ্ট্রীয় তৎপরতা নজিরবিহীন মাত্রা নিয়েছে।‘হিন্দুরাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে নাগপুরের সদর দপ্তর এখন লক্ষণীয়ভাবে সোচ্চার।
কেন্দ্রে তৃতীয় বার এবং বেশ কিছু রাজ্যে দফায় দফায় সরকার গঠনের সূত্রে সঙ্ঘ পরিবার রাষ্ট্র কাঠামোয় শক্ত ভিত গড়তে সক্রিয়। নিজেদের ভাবমূর্তিও তারা এখন নতুন রঙে রাঙিয়ে তুলতে তৎপর। অতীতে এবিষয়ে তেমন তৎপর না হলেও গেরুয়া ব্রিগেড এখন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম শরিক হিসাবে নিজেদের ভাবমূর্তি পুনঃনির্মাণ করতে চায়। আরএসএস’র শতবর্ষ তারা এভাবেই পালন করতে চায় সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাকে সামনে রেখে।
তাই ‘বন্দে মাতরম’ নিয়ে মুন্ডুপাত করা হচ্ছে নেহরুর। পরোক্ষে গান্ধীজীরও। সরকারি প্রকল্প থেকে মহাত্মার নাম ছেঁটে ফেলা হচ্ছে বিজাতীয় ঔদ্ধত্যে। কিছুদিন আগে রব তোলা হয়, সাভারকার আন্দামানে মুচলেকার চিঠি লিখেছিলেন নাকি গান্ধীজীর পরামর্শে। এখন শানানো হচ্ছে নতুন প্রচার—সঙ্ঘ পরিবার নাকি ১৯২৯ সালে লাহোর অধিবেশনে জাতীয় কংগ্রেসের ‘পূর্ণ স্বরাজ’ প্রস্তাবের পক্ষেও ছিল! ১৯৩০-র ২৬ জানুয়ারি ‘পূর্ণ স্বরাজ দিবস’ পালনেও তারা নাকি অংশ নেয়। হেডগেওয়ার তখন আরএসএস’র প্রধান।
তবে, ড. গোপাল পারশদ (Gopal Parshad) তাঁর ‘ন্যাশনাল মুভমেন্ট অ্যান্ড দি আরএসএস’ প্রবন্ধে ( আই ও এস আর জার্নাল অব অ্যাপ্লায়েড জিওলজি অ্যান্ড জিওফিজিক্স’;নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০১৮, পৃষ্ঠা ৭০-৮০) লিখেছেন, ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি গোলওয়ালকার আরএসএস কর্মী সমর্থকদের ‘গেরুয়া পতাকা’ তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কংগ্রেসের পতাকা নয়।
আরএসএস’র একজন অখিল ভারতীয় প্রচার প্রমুখ ‘অর্গানাইজার’ (২ অক্টোবর ২০২৫) পত্রিকায় ‘ আরএসএস অ্যাট ১০০: সংঘ ফাউন্ডার ড. হেডগেওয়ার অ্যান্ড হিজ কন্ট্রিবিউশন টু দি ফ্রিডম স্ট্রাগল’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন,‘১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আরএসএস’র প্রধান লক্ষ্য ছিল হিন্দু নেশনকে স্বাধীন করা।’ লক্ষণীয়, হিন্দুত্ববাদীদের স্ববিরোধিতা অলঙ্ঘনীয়! ‘হিন্দু নেশন’কে ‘স্বাধীন’ করার জন্য ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামর প্রয়োজন কী?
আরএসএস/ বিজেপি’র সঙ্কটের মূল কারণ হিন্দুত্ববাদ এবং ঔপনিবেশিকতাবাদবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের সম্পর্ক মৌলিকভাবেই পরস্পরবিরোধী। স্বাধীনতা সংগ্রামে নানা রাজনৈতিক ধারা ও প্রবণতার মধ্যে ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধিতার মৌলিক-অভিমুখের অভিন্ন পরিসরেই গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণতন্ত্র হিসাবে স্বাধীন ভারতের ধারণার আত্মপ্রকাশ। সঙ্ঘ পরিবারের পক্ষে ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল নীতি ও আদর্শগুলি আত্মস্থ করা অসম্ভব। ঔপনিবেশিকতাবাদ-বিরোধী রাজনীতির কোনও ধারা থেকেই সঙ্ঘ পরিবারের জন্ম হয়নি। ঔপনিবেশিক জমানার পৃষ্ঠপোষকতায় তার জন্ম। তাই স্বাধীনতা সংগ্রামের সব ধারারই তারা বিরোধিতা করে গেছে সমগ্র সময় পর্ব জুড়ে।
‘হিন্দুত্ব’ কর্মসূচি প্রতিষ্ঠা পর্ব থেকেই কোনও ঔপনিবেশিক-উত্তর সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের কথা বলেনি। অন্যদিকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ঔপনিবেশিকতার উৎখাত চেয়েছিল-- তার লক্ষ্য ছিল একটি গণতান্ত্রিক সমতাভিত্তিক আধুনিক সমাজ গঠন।
কিন্তু এমন কোনও দায়বোধ কাগজ-কলমেও হিন্দুত্ববাদের ছিল না। স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং হিন্দুত্ববাদের পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে। ‘হিন্দু’ ও ‘হিন্দুত্ব’কে গুলিয়ে ফেলে চলবে। দুটি এক নয়।
হিন্দুত্ববাদে ‘ধর্মীয়’ দ্বন্দ্বই যেহেতু মূল দ্বন্দ্ব তাই মুসলিম শাসকরাই ‘হিন্দুত্ব’-এর প্রধান প্রতিপক্ষ। সম্পদের লুণ্ঠনের ওপর গড়ে উঠা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার সঙ্গে হিন্দুত্ববাদের কোনও বিরোধ ছিল না। উলটে আপস ছিল। বিজেপি’র নেতারা তাই বাবরি মসজিদ ভাঙাকে ‘ভারতের ইতিহাসে দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন’ কিংবা ফরাসি বিপ্লবের সময়কার ‘বাস্তিল দুর্গ’ পতনের ঘটনার সমতুল্য বলে সোল্লাসে ঘোষণা করেছেন। এভাবেই তারা ঔপনিবেশিক শোষণ ব্যবস্থার মৌলিক কাঠামোকে আড়াল করে থাকে।
পাকিস্তান ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হিসাবে আবির্ভূত হলেও, গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণতান্ত্রিক হিসাবে ভারত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সাম্প্রদায়িক শক্তিকে, বিশেষত বিভক্ত ভারতের হিন্দুত্ববাদী পক্ষকে হতাশ করে। নাথুরাম গডসের হাতে গান্ধীজীর নির্মম হত্যা সেই হতাশারই ফলশ্রুতি।
তবে গান্ধীজীকে হত্যা করেই হিন্দুত্ব সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষান্ত হয়নি। স্বাধীন দেশে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের নিজস্ব কর্মসূচি বাস্তবায়নে তারা অবিচল থেকেছে। নয়াউদারবাদ পর্বে শাসক শ্রেণির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক দল হিসাবে বিজেপি’র ক্রমউত্থান কোনও পারম্পর্যবিহীন ঘটনা নয়।
হিন্দুত্ববাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি ধর্মমিশ্রিত রাজনীতি এবং সমাজের ধর্ম ও বর্ণভিত্তিক বিভাজন। এম এস গোলওয়ালকার তাঁর ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড’ গ্রন্থে যেমন লিখছেন, হিন্দুস্তানে ধর্ম হচ্ছে একধরনের সর্বভূতে বিরাজমান অস্তিত্ব’। (রিলিজিয়ান ইজ অ্যান অল-অ্যাবজর্ভিং এন্টিটি’)। এর অর্থ দাঁড়ায়, ধর্মীয় সত্তাই অবিকল্প পরিচিতি; যেন ধর্ম-বিযুক্ত কোনও পরিচিতি সত্তা অকল্পনীয়! হিন্দুত্ববাদ চায় রাজনৈতিক হিন্দু। যেমন ইসলামিক মৌলবাদও চায় রাজনৈতিক ইসলাম। সাম্প্রদায়িক শক্তির লক্ষ্য সাধারণভাবে ধর্মাচরণ নয়, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল।
হিন্দুত্ববাদীদের মতে, হিন্দু জাতি-রাষ্ট্র নাকি ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র (থিওক্রেটিক স্টেট) নয়। রাষ্ট্রের জাতি পরিচয় ঘোষণা মানে নাকি রাষ্ট্র ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয় না এবং হিন্দু রাষ্ট্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র একইসঙ্গে হওয়া সম্ভব! ‘ইন্টিগ্রাল হিউম্যানিজম’ গ্রন্থে দীনদয়াল উপাধ্যায় ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘‘ধর্মনিরপেক্ষতা (ধর্মের প্রতি উদাসীনতার মনোভাব) এবং রাষ্ট্র (স্টেট) পরস্পরবিরোধী ধারণা। রাষ্ট্র শুধুমাত্র ধর্মরাজ্যই হতে পারে, অন্য কিছু নয়।’’ সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘সেক্যুলারিজম’ এবং ‘সোশালিজম’ শব্দদুটির অপসারণের ধারণাকে জনপ্রিয় করতে শাসকদের অতিসক্রিয় ভূমিকাও এপ্রসঙ্গে উল্লেখ্য। ‘হিন্দুত্ব’ সাম্প্রদায়িক শক্তি তার যাবতীয় পশ্চাৎবর্তী রাজনৈতিক ও মতাদর্শের জন্মদাগ নিয়েই আজকের আধুনিক সময়ের চ্যালেঞ্জ নিতে চাইছে। যত বেশি তার নির্বাচনী সাফল্য তত বেশি সে আঁকড়ে ধরছে পশ্চাৎবর্তী প্রতিক্রিয়ার রাজনৈতিক কর্মসূচি।
Comments :0