Editorial

যাক অবশেষে...

সম্পাদকীয় বিভাগ

ভারত ও চীনের সম্পর্কের প্রশ্নে বামপন্থী তথা কমিউনিস্টদের অবস্থান যে কালের বিচারে অভ্রান্ত তা আরও একবার প্রমাণিত হলো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর চীন সফর এবং চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিঙের সঙ্গে বৈঠকের ফলাফল থেকে। কমিউনিস্টরা বরাবর একথা জোরের সঙ্গে বলে এসেছে। চীন সহ যে‍ কোনও প্রতিবেশী দে‍‌শের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং সেটা বজায় রাখা ভারতের সামগ্রিক বিকাশের স্বার্থে জরুরি। বিরোধ-মতপার্থক্য থাকতেই পারে, তাকে সংঘাত বা যুদ্ধের দিকে ঠেলে না দিয়ে কূটনৈতিক পথে আলোচনার মাধ্যমেই মিটমাট করার প্রয়াস চালাতে হবে। শত্রুতা নয় বন্ধুত্বই পারস্পরিক বিকাশ ও উন্নতির প্রধান শর্ত। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় এই অবস্থান নিয়েছিল বলে কমিউনিস্টদের চীনের দালাল বলে দেগে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে দেশের প্রায় সব কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেপ্তার করে জেলে পোরা হয়েছিল। কিন্তু কমিউনিস্টরা আজও এই প্রশ্নে তাদের অবস্থানে অবিচল। যুদ্ধ কোনোদিন কোনও সমস্যার সমাধান করতে পারে না। শুধু ধ্বংস করে আর অগুণতি মানুষের মৃত্যু ও বিপর্যয়ের কারণ হয়। দেশের শাসকরা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে বিরোধ খুঁচিয়ে শত্রু তৈরি করে। তারপর তার বিরুদ্ধে ক্রমাগত আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিয়ে অতি দেশপ্রেমিক সাজার চেষ্টা করে। দেশপ্রেমের জোয়ারে অবগাহন করে ভোট বৈতরণী পার হবার চেষ্টা করে। এই প্রশ্নে তথাকথিত জাতীয়তাবাদী সব শাসকেরই চরিত্র প্রায় এক।
বাজপেয়ীর নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসার পর দেখা গেছে আচমকাই চীন বিরোধী অবস্থান দ্রুত বেড়ে গেছে। মোদী জমানা শুরুর দিকে মোটামুটি চীনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলেও ডোকলাম ও গালওয়ান পর্বকে কেন্দ্র করে সম্পর্ক দ্রুত খারাপ হতে থাকে। একসময় সেটা ঘোরতর শত্রুতায় পরিণত হয়। দু’দেশের মধ্যে কার্যত সব সম্পর্কই ছিন্ন করে দেওয়া হয়। চীনের অ্যাপ, চীনের বিনিয়োগ ভারতে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। দু’দেশের মধ্যে বিমান চলাচল বন্ধ হয়। চীনের নাগরিকদের ভারতে ভিসাও কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। তার সাথে সাথে ক্রমাগত চীন বিরোধী প্রচারের ঝড় তুলে চীনকে এক‍‌টি ভয়ঙ্কর ভারত বিরোধী শক্তি হিসাবে তু‍‌লে ধরা হয়। হিন্দুত্ববাদীরা চীনের পণ্য বর্জনের ডাক দেয়। চীনকে বয়কটের ধুয়ো তোলে।
এসব করে চীনকে কতটা বেকায়দায় ফেলা গেছে বলা মুশকিল, তবে ভারত যে বেজায় সমস্যায় পড়েছে তাতে সন্দেহ নেই। মোদীরা যতই অর্থনীতির ভিত শক্তিশালী বলে প্রচার করুন বা আত্মনির্ভরতার হাওয়া তুলুন বাস্তবে চীন থেকে আমদানি আটকে যাওয়ায় ভারতে অনেক শিল্প ক্ষেত্রের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। গত দেড়-দু’বছর থেকেই দেশের কর্পোরেট ও বাণিজ্য মহল বণিকসভাগুলির মাধ্যমে সরকারের উপর লাগাতার চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সহজ করার জন্য। মনে রাখা দরকার চীন থেকে শুধু পণ্যই ভারতে আসে না। ভারতে যেসব পণ্য তৈরি হয় তার কাঁচামালও আসে চীন থেকে। সার ও সারের কাঁচামাল আসা বন্ধ হবার ফলে দেশের কৃষি ক্ষেত্রে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। সার সঙ্কটে জর্জরিত কৃষকরা। ওষুধ তৈরির বেশিরভাগ কাঁচামাল আসে চীন থেকে। রেল, সড়ক, মেট্রো, জলবিদ্যুৎ ইত্যাদির জন্য অতি প্রয়োজনীয় ট্রানেল বোরিং মেশিন আসে চীন থেকে। ফলে বহু প্রকল্প থমকে গেছে। ইলেকট্রিক গাড়ি, সৌর বিদ্যুৎ, ইলেকট্রনিক্স, মোবাইল থেকে শুরু করে বহু ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় বিরল ধাতু আসে চীন থেকে। ফলে শিল্পোৎপাদনের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে উৎপাদন সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তার উপর ট্রাম্পের শুল্ক আগ্রাসন। সব মিলিয়ে মোদীদের অবস্থা এতটাই কোণঠাসা যে চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছাড়া দ্বিতীয় কোনও রাস্তা আপাতত খোলা নেই। সাত বছর পর মোদীকে তাই চীন সফরে যেতে হলো। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে চীনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে সাধারণ স্বার্থ ও বৈদেশিক স্বার্থ রক্ষার তাগিদে মোদী সরকারের এই বোধোদয় অভিনন্দনযোগ্য।
 

Comments :0

Login to leave a comment