এসএসসি’র নিয়োগ দুর্নীতিতে এখনও পর্যন্ত প্রায় ২১ হাজার পদে ভুয়ো নিয়োগ হয়েছে বলে কলকাতা হাইকোর্টকে জানালো সিবিআই। সোমবার হাইকোর্টের বিচারপতি বিশ্বজিৎ বসুর এজলাসে দাঁড়িয়ে সিবিআই’র সিট বা বিশেষ তদন্তকারী দলের প্রধান অশ্বিন সেনতি এই কথা বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, তদন্তকারী সংস্থার হাতে যে নথি এসেছে, সেখানে এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। এই ২১ হাজারের মধ্যে এখনই ৯ হাজার জনের ওএমআর শিট বিকৃত করার তথ্য সিবিআই হাতে পেয়েছে। এখনও ভুয়ো নিয়োগের স্ক্রুটিনির কাজ শেষ হয়নি। সোমবার কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে মামলাকারীদের আইনজীবীরা বলেছেন, এসএসসি’র নিয়োগ দুর্নীতি দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি হিসাবে চিহ্নিত হবে। সোমবার কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি বিশ্বজিৎ বসু এর পরিপ্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন, এসএসসি’র নিয়োগ দুর্নীতিতে বিরাট ব্যাপকতা রয়েছে। এই দুর্নীতির শেষ দেখা দরকার। এই ভুয়ো নিয়োগের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের ছাড়া হবে না। 
এদিন বিচারপতি বিশ্বজিৎ বসুর এজলাসে হাজির হয়েছিলেন সিবিআই’র সিট বা বিশেষ তদন্তকারী দলের প্রধান অশ্বিন সেনতি। তিনি আদালতকে জানান, নিয়োগের জন্য যে প্যানেল তৈরি হয়েছিল, সেখান থেকে ওয়েটিং লিস্ট পর্যন্ত ভুয়ো তথ্য রয়েছে। গত বছর নভেম্বর মাস থেকে সিবিআই র্যা ঙ্ক জাম্পিং (ক্রমাঙ্কে কারচুপি করে পিছন থেকে কাউকে এগিয়ে নিয়ে আসা) নিয়ে যে তদন্ত করেছে, সেখানে বড় রকমের অস্বচ্ছতা পাওয়া গিয়েছে। এই বক্তব্য শুনে এদিন বিচারপতি বসু সিবিআই-কে বলেছেন, তদন্তের গতি বাড়াতে হবে। যখনই প্রয়োজন হবে, আদালতে আসতে পারে সিবিআই। যোগ্য প্রার্থীরা তাঁদের নিয়োগপত্র চাইছেন। তাঁরা সিবিআই কী তদন্ত করছে বা আদালত কী বলছে, সেই সব ভাবছেন না। তাঁরা চাইছেন মেধাভিত্তিক নিয়োগ। দ্রুততার সঙ্গে নিয়োগে কী দুর্নীতি হয়েছে, তা সামনে আনতে হবে।
এসএসসি নিয়োগপত্র দিয়েছে নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশের শিক্ষকপদে। স্কুলের গ্রুপ-ডি এবং গ্রুপ-সি পদে শিক্ষাকর্মী নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। এই ছ’টি ক্ষেত্রের সবেতেই ভুয়ো নিয়োগ হয়েছে। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে নিয়োগে বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছেন প্রার্থীরা। মামলাগুলির শুনানি চলছে।
গত ৩১ মার্চ স্কুলে গ্রুপ-ডি পদে শিক্ষাকর্মী নিয়োগে দুর্নীতির মামলায় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নির্দেশ দিয়েছিলেন, তৎকালীন নজরদারি কমিটির উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিনহাকে সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদ করবে। হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে এর আগেও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ নিয়ে একাধিক মামলার শুনানি হয়েছে। গ্রুপ-ডি পদে নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ অনেক আগে উঠলেও নন্দীগ্রামের লক্ষ্মী টুঙ্গা নামে এক চাকরিপ্রার্থী তাঁর আবেদনে অভিযোগ করেছেন, সম্প্রতি গ্রুপ-ডি পদে যে ৯৬ জনকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে ৯০ জনের নামই প্যানেলে নেই। এরপর থেকেই একের পর এক অভিযোগ নিয়ে মামলা দায়ের হয়েছে। গ্রুপ-সি পদের শিক্ষক নিয়োগ নিয়েও বহু মামলা রয়েছে। শিক্ষা দপ্তরের  তৈরি করা নিয়োগ সংক্রান্ত নজরদারি কমিটির উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিনহা এবং প্রোগ্রামিং অফিসার সমরজিৎ আচার্য সেই সময়ে আদালতকে জানিয়েছিলেন, এসএসসি কোনও নিয়োগপত্র দেয়নি। এই নিয়োগপত্র দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ মধ্য শিক্ষা পর্ষদ। অন্যদিকে পর্ষদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, এসএসসি’র সুপারিশ অনুযায়ী এই নিয়োগ হয়েছে। এখানে পর্ষদের কোনও হাত নেই। 
গত ৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতা হাইকোর্ট স্কুলে গ্রুপ-ডি পদে ৫৭৩ জনের নিয়োগ বাতিল করেছিল। আদালত তার নির্দেশে বলেছিল, যত দ্রুত সম্ভব এই কর্মীদের বরখাস্ত করতে হবে। এই ৫৭৩ জন কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রেও এসএসসি আদালতে দাঁড়িয়ে বেমালুম বলে দিয়েছিল, এদের নিয়োগের দায় মধ্যশিক্ষা পর্ষদের। এই নিয়োগের মামলাগুলিতেই সিবিআই তদন্ত করছে। শুধু এসএসসি‘র নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের উত্তরপত্র নষ্ট করা হয়েছে, এমনটি নয়। প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের জন্য ২০১৪-তে অনুষ্ঠিত টেট-এ বসেছিলেন ২০ লক্ষ প্রার্থী। এই প্রার্থীদের মধ্যে প্রায় ১৩ লক্ষের উত্তরপত্র নষ্ট করে ফেলেছে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ। কার নির্দেশে এই ওএমআর শিট বা উত্তরপত্র নষ্ট করে দেওয়া হলো, তার কোনও সদুত্তর পর্ষদ আদালতে দিতে পারেনি। আদালত বলেছে, নির্দিষ্ট একটি সংস্থাকে দিয়ে এই ওএমআর শিট নষ্ট করা হয়েছে। এই ওএমআর শিটনষ্ট করার সময়ে পর্ষদের কোনও আধিকারিক উপস্থিত ছিলেন না। কারা এই ওএমআর শিট কোথায় নিয়ে গেল, তা পর্ষদের আধিকারিকরা জানেন না। এই গোটা প্রক্রিয়ার সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হয়েছে, তাও কেউ বলতে পারছেন না। এসএসসি এবং টেট’র মাধ্যমে নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে একইসঙ্গে। কলকাতা হাইকোর্ট মন্তব্য করেছে, এই ভুয়ো নিয়োগ প্রক্রিয়া নিছক ভুল নয়, এটি একটি সংগঠিত অপরাধ। অপরাধীদের খুঁজে বের করতে হবে। টেট’র মতোই এসএসসি’র ওএমআর শিটে জালিয়াতির তথ্য সামনে আসার পর সোমবার আদালত এসএসসি’র উদ্দেশে মন্তব্য করেছে, ‘‘নোংরা জল স্বচ্ছ করার চেষ্টা করুন। যোগ্য প্রার্থীদের সুযোগ দিন।’’
একইভাবে ইতিমধ্যে নিয়োগকাণ্ডে ধৃত প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের অপসারিত সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে আদালতে আরেক কেন্দ্রীয় সংস্থা ইডি জানায়, ২০১১ সালের পর থেকে তিনি পর্ষদ সভাপতি থাকাকালীন এক দশকে ৫৮ হাজার নিয়োগ হয়েছিল প্রাথমিকে। গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েই গুরুতর সন্দেহ প্রকাশ করে আদালতে ইডি জানায়, টাকার বিনিময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া হয়েছে মানিক ভট্টাচার্যের সময়কালে, তা ইতিমধ্যেই তদন্তে সামনে এসেছে। তাঁর সরকারি পদকে ব্যবহার করেই এই দুর্নীতি হয়েছিল। 
প্রাইমারি টেট থেকে এসএসসি’র এই ভুয়ো নিয়োগ ও দুর্নীতির ছবি স্বাধীনোত্তর পশ্চিমবঙ্গে এক বেনজির ঘটনা। সিবিআই আদালতে এর আগে একাধিকবার বলেছিল, প্রজন্মকে নষ্ট করেছে এই দুর্নীতি।
 
                                         
                                    
                                 
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                    
Comments :0