Amit Shah

নাৎসিদের আড়াল করে রবীন্দ্র-বন্দনার চেষ্টা শাহের

কলকাতা

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দু’টি দেশের জাতীয় সঙ্গীত রচনার বিরাট কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। মঙ্গলবার কলকাতায় দু’বার এই কথা বলেছেন অমিত শাহ্।
 একবার জোড়াসাঁকোয়— সকালে। পরের বার সন্ধ্যায়— সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে আলোচনাসভায়। কিন্তু তিনি বলেননি যে, ২০১৬-তেও সঙ্ঘের নেতা ভাইয়াজী যোশী স্পষ্ট জানিয়েছিলেন যে, ‘জনগণমন’কে তাঁরা জাতীয় সঙ্গীত মনে করেন না।
 তাঁরা মানে কারা? আরএসএস। সেই আরএসএস’ই এদিন ‘কবি প্রণাম’ শীর্ষক আলোচনাসভার আয়োজন করেছিল সন্ধ্যায়। তবে ‘খোলা হাওয়া’ নামে।
 সেই আলোচনাসভায় বারবার সঙ্ঘের অবস্থানকে আড়াল করে রবীন্দ্র-চেতনা নিয়ে ভাষণ দিতে হয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে।
 কেমন? যেমন হিটলারের জার্মানি নিয়ে।
 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ফ্যাসিবাদ বিরোধী অবস্থানের উল্লেখ করলেন। কিন্তু মঙ্গলবার, সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে আলোচনায় অমিত শাহ সযত্নে এড়িয়ে গেলেন ‘ফ্যাসিবাদ’, ‘নাৎসি’, ‘হিটলার’ শব্দগুলি।
 স্বাভাবিক। অমিত শাহের বেড়ে ওঠা যে সংগঠনে, সেই সংগঠনের ‘গুরুজি’ সদাশিব গোলওয়ালকার হিটলারের ‘আর্যরক্ত’-র শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের অপচেষ্টাকে সমর্থন করেছিলেন। আরএসএস ‘ফ্যাসিস্ত’-দের প্রতি প্রবল সহানুভূতিশীল। ফ্যাসিস্তদের মতই সঙ্ঘ এবং বিজেপি কমিউনিস্টদের প্রধান শত্রু বলে চিহ্নিত করে রেখেছে। তাই আইনস্টাইনের হিটলার-শাসিত জার্মানি ত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার বিরুদ্ধে ১৯৩২-এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খোলা চিঠির উল্লেখ করে অমিত শাহ বললেন, ‘‘জার্মানিতে তখন যে অবস্থা চলছিল তার বিরুদ্ধে কবিগুরু খোলা চিঠি লেখেন একটি পত্রিকায়।’’
 জার্মানিতে ‘কী অবস্থা চলছিল?’ অমিত শাহ্‌ তার ধারেকাছে যাননি। তারও আগে রবীন্দ্রনাথ ১৯২৬ সালের ৫ আগস্ট, ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান পত্রিকায় একটি চিঠি লিখে ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে তাঁর মোহভঙ্গের কথা ব্যক্ত করেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে মুসোলিনির ভাই নিজেদের দলীয় মুখপত্র পোপোলো ‘দ্য ইতালিয়ার’ পত্রিকায় কবিকে কুৎসিত আক্রমণ করেন। অমিত শাহ্ স্বভাবতই তার উল্লেখ করেননি। একই ভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কে আগে থেকে লিখে আনা বক্তব্য পাঠের সময় কবির জীবনের একটি বিশেষ এবং গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়কে স্রেফ বাদ দিয়ে চলে গেছেন ‘শান্তিনিকেতন সম্পর্কে অনেক পড়াশোনা’র দাবি করা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অমিত শাহ একবারও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাশিয়ার চিঠি’র উল্লেখ করেননি। বিপ্লব পরবর্তী রাশিয়ার দুর্দান্ত অগ্রগতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলির প্রসঙ্গেই যাননি অমিত শাহ।  
    বিজেপি এবং আরএসএস’র বিরুদ্ধে ভারতে কমিউনিস্টরা লাগাতার আদর্শগত লড়াই চালাচ্ছে। এই প্রশ্নে কমিউনিস্টরাই সঙ্ঘের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এদিন কমিউনিস্টদের নাম না করে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলেন অমিত শাহ— সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে। কিন্তু খুবই দুর্বল ছিল তাঁর বক্তব্য।
 ‘শান্তিনিকেতনের শিক্ষা পদ্ধতি’ নিয়ে আলোচনা করেছেন অমিত শাহ। বলেছেন,‘‘শান্তিনিকেতনের ভাবনা অনুকরণীয়। সেই পথ আরও দৃঢ় করা প্রয়োজন আমাদের।’’ কিন্তু আজকের শান্তিনিকেতনে কী চলছে? বিশ্বভারতী নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকে তাঁর বাড়ি থেকেই উচ্ছেদ করতে চাইছে। ছাত্র, অধ্যাপকদের নির্দয়ভাবে দমন করতে চাইছে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। ‘গুরুদেব’-র শান্তিনিকেতনের এই হাল নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোনও মন্তব্য করেননি। তবে তিনি দাবি করেছেন,‘‘গুরুদেব মাতৃভাষায় শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়েছেন বারবার। এবারে জাতীয় শিক্ষানীতি তৈরি করার সময়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী সেই বিষয়টিতে বিশেষ লক্ষ্য রেখেছেন। মাতৃভাষায় শিক্ষায় জোর দেওয়া হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতিতে।’’
  যে শিক্ষানীতিতে দেশের আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার সুযোগ সঙ্কুচিত হবে বলে দেশে বিভিন্ন অংশের মানুষ প্রতিবাদ করছেন, সেই শিক্ষানীতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এইভাবেই জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন অমিত শাহ।
 অমিত শাহ ‘সভ্যতার সঙ্কট’-র উল্লেখ করেছেন। এনআরসি’র নামে যখন সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে তখন, ‘সভ্যতার সঙ্কট’-র সূত্রে অমিত শাহ বলেছেন,‘‘আজ দেশে যে সঙ্কীর্ণ রাজনীতি দেখি তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।’’  
সেই অনুষ্ঠান চলাকালীন সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামের বাইরে বিজেপি’র নেতা, কর্মীদের মারামারি করতে দেখা যায়। মূলত কে কোন দরজা দিয়ে ঢুকবে তা নিয়েই ঝামেলা।
 এদিন রাজ্যে একাধিক অনুষ্ঠানে ছিলেন অমিত শাহ। সকালে জোড়াসাঁকো ঠাকুবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূর্তিতে মালা দেন। ঘুরে দেখেন ঠাকুরবাড়ি। গুজরাটিতে নিজের প্রতিক্রিয়া লেখেন রেকর্ড বুকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মসময় এবং তিথি তাঁকে জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন অমিত শাহ। সেখান থেকে তিনি পেট্রাপোলে একটি সরকারি অনুষ্ঠানে যান। ল্যান্ড অ্যান্ড পোর্ট অথরিটি আয়োজিত সেই অনুষ্ঠানে কার্গো গেটের উদ্বোধন করেন তিনি। সেখানে তিনি বলেন,‘‘দ্বিতীয় এই কার্গো গেট তৈরি হওয়ায় ভারত এবং বাংলাদেশের বন্ধন আরও সুদৃঢ় হবে।’’
এদিন সায়েন্স সিটির অনুষ্ঠানে এছাড়াও বক্তব্য রাখেন বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী।
.............................
ক্যাপশন: জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে অমিত শাহ।

 

Comments :0

Login to leave a comment