সাড়ে চার বছর সরকার চালানোর পর বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক ছ’মাস আগে উত্তর প্রদেশের বিজেপি সরকারের হঠাৎ মনে হলো জনসংখ্যা কম না হলে উন্নয়নের কাজ যথাযথ হয় না এবং উন্নয়নের সুফলও মানুষের কাছে পৌঁছায় না। তাই ভোটের মুখে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ঘটা করে রাজ্যের জনসংখ্যানীতি ঘোষণা করেছিলেন। এই প্রশ্নে রাজ্য আইন কমিশনের ওয়েবসাইটে একটি খসড়া প্রস্তাব প্রকাশ করে জনসাধারণের মতামত জানানোর জন্য দশদিন সময় দেওয়া হয়েছে। অথচ তার তিনদিন কাটতে না কাটতেই মুখ্যমন্ত্রী সরকারের নীতি ঘোষণা করে দিয়েছেন। ফলত এটা পরিষ্কার জনসাধারণের মতামত নেওয়াটা নেহাতই লোক দেখানো। সরকার উন্নয়নের দোহাই দিয়ে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বিশেষ করে ভোটে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করে বিভাজন ও মেরুকরণের ফায়দা লুটতে যা যা করার আগেই ঠিক করে ফেলেছে। জনসাধারণের মতামত তাদের কাছে মূল্যহীন।
মনে রাখতে হবে জনসংখ্যা হঠাৎ মনে হওয়া কোনও ছেলেমানুষী বিষয় নয়। জনসংখ্যার হ্রাস বৃদ্ধির প্রভাব সাময়িক বা তাৎক্ষণিকভাবে অনুভব করা যায় না। এটা একটা দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া। তাই জনসংখ্যা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে গেলে কম করে ১৫-২০ বছরের প্রবণতা এবং সমাজ সংস্কৃতি অর্থনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে তার প্রভাব গভীরভাবে অনুধাবন করতে হয়। সেই অনুশীলন ও অনুধাবনে অর্জিত জ্ঞান থেকে আগামী ১৫-২০ বছরের সম্ভাব্য ছবিটাও এঁকে নিতে হয় তারপর ঠিক করতে হয় জনসংখ্যা হ্রাস বা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কখন কতটা এবং কীভাবে হস্তক্ষেপ করা যায়। তারজন্য কেমন ধরনের সরকারি নীতি ও আইন করা যায়। সন্তান জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে জৈবিক, শারীরিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি নানা বিষয়। তাছাড়া এটা নাগরিক অধিকারের প্রশ্নও। সর্বোপরি এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অর্থনীতির বিকাশের মৌলিক শর্তও।
জনসংখ্যা কমলে অর্থনীতির বিকাশ ও উন্নয়ন তরতর করে বাড়ে অর্থশাস্ত্রে এমন কোনও তত্ত্বের স্বীকৃতি নেই। বরং জনসংখ্যা কমে গেলে অর্থাৎ বৃদ্ধির হার একটা স্তরের নিচে নামলে অর্থনীতির বিকাশ অবরুদ্ধ হয়ে যায়। সন্তানের জন্ম মহিলা প্রতি দুইয়ের নিচে নামতে শুরু করলে সমাজে বয়স্ক ও নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাদের ভার বহন করতে হয় কর্মক্ষম কম বয়সিদের। তাছাড়া অর্থনীতিতে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলে একটা কথা আছে। ইতিহাস প্রমাণ করে দিয়েছে যে কোনও অগ্রসর বা অগ্রসরমান অর্থনীতির উত্থান ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ছাড়া সম্ভব নয়।
জোর করে জনসংখ্যা কমানোর চেষ্টা আধুনিক বিশ্বে একটি ভ্রান্ত ও পরিত্যক্ত ভাবনা। অযোগ্য, ব্যর্থ ও অপদার্থ শাসকের মনে এই ধরনের অবৈজ্ঞানিক ও অবাস্তব চিন্তা বাসা বাঁধে। শিক্ষার প্রসার, আর্থ-সামাজিক বিকাশ, বেকারি হ্রাস, কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, কর্মক্ষেত্রে মহিলাদেরও সমানতালে যোগদান ইত্যা্দি সুনিশ্চিত হলে জনসংখ্যা আপনা থেকেই কমে যায়। বিশ্বে এর ভূরি ভূরি নজির আছে। উন্নয়নের একটা স্তরে পৌঁছে গেলে জনসংখ্যা কমে যাবার বিপদ আসে। কয়েক ডজন দেশ ইতিমধ্যেই সেই বিপদের মুখে। জাপান, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া সহ বহু দেশ এখন বেশি সন্তানের জন্য যথেচ্ছ সরকারি সাহায্য দিতে বাধ্য হচ্ছে। তাতেও সন্তান বাড়ছে না।
উত্তর প্রদেশের বর্তমান সমস্যা জনসংখ্যা নয়। সরকারের নীতিগত ও প্রশাসনিক অপদার্থতা। গত এক দশকে তথ্য দেখলে দেখা যাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কিন্তু দ্রুত কমছে। শহরাঞ্চলে নির্দিষ্ট সীমার নিচেও নেমেছে। তবে গ্রামে এখনো অনেকটা বেশি। শিক্ষা ও রুজি রোজগারের সুযোগ বাড়লে গ্রামেও তা কমতে বাধ্য। হিন্দুত্ববাদী ধর্মান্ধ ও কুসংস্কারে কুয়োয় বসবাসকারী উত্তর প্রদেশের সরকার মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও বিজ্ঞান চেতনা বিকাশে পুরোপুরি ব্যর্থ। অর্থনীতির বিকাশও পশ্চাৎমুখী। দারিদ্র ও পশ্চাৎমুখী চেতনা থেকে বেরিয়ে উদার ও প্রগতিশীল চিন্তা না বাড়লে উন্নত জীবন ধারা অধরাই থেকে যাবে। সরকারের এই অক্ষমতা ও ব্যর্থতা আড়াল করতে এখন জনসংখ্যা কমানোর জিগির।
Editorial on population
ব্যর্থতা আড়ালের কৌশল
                                    
                                
                                    ×
                                    
                                
                                                        
                                        
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
Comments :0