যে মতবাদের প্রতি একদিন গোটা বিশ্বের ঘৃণা বর্ষিত হয়েছিল, পৃথিবীর সবচাইতে নিন্দিত এবং ধিক্কৃত সেই ফ্যাসিবাদেরই অনুসারী যখন ১০০ বছর বাদে নতুন করে সেই মুসোলিনির ইতালিতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হলো, তখন একটি কথাই বলা যেতে পারে— সোভিয়েত আক্রমণের অভিঘাতে ফ্যাসিবাদের বাহ্যিক কাঠামোটি ধ্বস্ত হয়ে পড়লেও, তার ভিত অর্থাৎ মতাদর্শটি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়নি। নতুন পরিস্থিতিতে নতুন উপাদানের উপরে ভিত্তি করে তারা নতুন নতুন ইমারত গড়ে তুলছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। যদিও সঙ্কটাপন্ন পুঁজিবাদের অনিবার্য পরিণতিতে যেভাবে বৈষম্য তথা মানুষের জীবন যন্ত্রণা বাড়ছে, তাতে এই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের সোচ্চার হবার কথা।
অথচ ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে মানুষের তিক্ত অতীত অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও, কেন মানুষ সেই পুঁজিবাদের চরম প্রতিক্রিয়াশীল, প্রকাশ্য সন্ত্রাসবাদী অংশের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন! কী এমন নতুন উপাদান তারা পেলেন যার জন্য সেটিকে মানুষ নতুন করে আঁকড়ে ধরছেন! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে, প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়া একটি মতবাদের নতুন করে শক্তি সংহত করার রসায়নটির চর্চা করাটা জরুরি। নচেৎ বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যেই কীভাবে এত সহজে ফ্যাসিবাদের ঘোষিত অনুসারীরা ইতালিতে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করল, সেটা বোঝা যাবে না। এটা মনোবৈকল্য কিংবা হতাশা নয়, এটি ফ্যাসিবাদী সাংস্কৃতিক দাপটের কাছে জনগণের অসহায় আত্মসমর্পণ।
কীভাবে তা সম্ভব হলো, তা বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে চীনা বাঁশের বেড়ে ওঠার গল্পটি উদাহরণ হিসাবে বিবেচনা করা যেতেই পারে। ওই বাঁশের বীজ মাটিতে রোপণ করার পাঁচ বছর বাদে নাকি তার অঙ্কুরোদগম হয়। চটজলদি ফলের আশায় থাকা মানুষের এতে ধৈর্যচ্যূতি ঘটে, সহজেই হতাশ হয়ে পড়েন। কিন্তু ফ্যাসিবাদ একবারের জন্যেও হতাশ হয়নি। পরিস্থিতি যত প্রতিকূলই হোক, অটুট অধ্যবসায় এবং অসীম ধৈর্য সহকারে তারা নিজেদের মতাদর্শকে পরিচর্যা করে গেছে নিরলসভাবে। নিয়ম করে তারা তাতে জল, সার ইত্যাদি প্রয়োগ করে গেছে। কারণ ওদের এই আত্মবিশ্বাস ছিল, সকলের অগোচরেই ওই বীজ মাটির নিচে নিজের শিকড়-বাকড়গুলি প্রতিদিন তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে চলেছে গভীর থেকে আরও গভীরে। শক্তি সংগ্রহ করছে, সংহত করছে নিজেকে। তারপর একদিন আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যখন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে ছোট্ট একটি অঙ্কুর। যেটি অবিশ্বাস্য হারে বেড়ে উঠে, মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে ৯০ ফুটের উচ্চতা ছুঁয়ে ফেলবে।
যেহেতু পরিচর্যার পাঁচ বছর সময়টিকে আমরা বিবেচনার মধ্যে আনছি না, তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হঠাৎ করে ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থান দেখে আমরা অনেকেই বিহ্বল হয়ে পড়ছি। প্রকৃতপক্ষে গোটা বিশ্বে ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থানের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ফ্যাসিবাদের পতনের দিন থেকেই। পতন থেকে শিক্ষা ফ্যাসিবাদ নিজেদের পুনর্গঠনের কাজে হাত লাগিয়েছিল। নিজেদের মতাদর্শের প্রতি জনগণের সম্মতি নির্মাণের লক্ষ্যে নীরবে কাজ চালিয়ে গেছে সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে। প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছে মানুষের চিন্তার জগতে। এবং সেই অভিমুখেই তারা তাদের যাবতীয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডগুলিকে পরিচালিত করেছে। এবং সেক্ষেত্রে তাদের সাহায্য করেছে, গ্রামসি কথিত পরম্পরাগত বুদ্ধিজীবীরা। তত্ত্বগতভাবে সেই কর্মকাণ্ডের প্রথমটি যদি হয় একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার সফল রূপায়ণ, দ্বিতীয়টি হলো সেই একনায়কের অতিমানবীয় ভাবমূর্তি নির্মাণ এবং তার সাথে প্রাচীন সংস্কৃতির গৌরবময় ইতিহাসকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি।
শুধু দমন-পীড়ন নয়, চলার পথে তারা এমন এক সাংস্কৃতিক প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যাতে ব্যক্তি তার নিজস্বতাকে বিমূর্ত সামাজিক সমষ্টির হাতে সঁপে দিতে বাধ্য হয়। এটাই হলো ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির স্বরূপ। তাদের নন্দনতত্ত্ব এমন এক স্বপ্নময় জগতের প্রেক্ষাপট রচনা করে, যার মধ্যে দিয়ে মানুষের চিন্তা-ভাবনা, বুদ্ধি-বিবেচনাগুলি ক্রমশ শিথিল হতে থাকে। পুঁজিবাদী আগ্রাসনের ফলে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভবিষ্যৎ ইত্যাদি যখন প্রশ্ন চিহ্নের মুখে, তখন যন্ত্রণাবিদ্ধ সেই বর্তমানকে ভুলিয়ে দিতে, স্বপ্নময় এক কাল্পনিক জগৎ নির্মাণ ক'রে মানুষের বোধশক্তিগুলির ধ্বংসসাধন সুনিশ্চিত করে। এই লোপ পাওয়া বোধশক্তি এমন এক প্রশ্নহীন সমাজের জন্ম দেয়, যাতে অনিশ্চয়তার আতঙ্ক থেকে মুক্তি লাভের আশায় মানুষ ফ্যাসিবাদ নির্মিত তথাকথিত অসীম ক্ষমতাবানের শরণ নিতে বাধ্য হন।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ইতালিতে ফ্যাসিবাদী সাংস্কৃতিক প্রকল্প রূপায়ণ করার প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল, শাসক মুসোলিনির অতিমানব ভাবমূর্তি নির্মাণ। এর পাশাপাশি তারা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছিল। যার জন্য ইতালি জুড়ে প্রাচীন গ্রিক-রোমান সাম্রাজ্যের আদলে অতিকায় সব স্থাপত্য, ভাস্কর্য ইত্যাদি নির্মাণের কাজ চালানো হয়েছিল। অন্যদিকে, নিরন্তর প্রচার চালানো হয়েছিল বেতার, বিজ্ঞাপন এবং জনসভার মাধ্যমে। একই ঘটনা পরিলক্ষিত হয়েছিল জার্মানিতেও। অতিকায় নির্মাণ ছাড়া আত্মপ্রচারের সমস্ত অনুষঙ্গই ব্যবহার করেছিলেন হিটলারও। হাল আমলের মোদী- মমতাও সেই একই পথে হাঁটছেন। রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ব্যবহার করে এরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ভাবমূর্তি নির্মাণের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। আসলে জনগণের সম্ভ্রম আদায় করার জন্য পৃথিবীর সমস্ত স্বৈরাচারী শাসকই এই পন্থা অবলম্বন করে থাকেন। উদ্দেশ্য একটাই– ‘ওই মূর্তি দেখে লোকে পায় যেন টের, কত শক্তি ধরে রাজা হীরকের’!
বর্ষপূর্তি উৎসব উপলক্ষে তোরণ, আতশবাজি, রঙিন ফানুস, পাঁচশো নতুন নিশান, সর্বোপরি বিশ হাত উঁচু রাজার এক অতিকায় মূর্তি নির্মাণের আয়োজনের মধ্যেই রাজা তার কর্মসূচিকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। ব্যবহার করলেন সেই সমস্ত পরম্পরাগত বুদ্ধিজীবীদের, তাদের মধ্যে কেউ আবিষ্কার করলেন ‘মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্র’। কেউ রচনা করলেন মন্ত্র। যে মন্ত্র মানুষের মগজে রোপণ করা হবে, রাজভক্ত নাগরিক গড়ে তোলার লক্ষ্যে। তাই, সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের জন্য রচিত হলো আলাদা আলাদা ‘রাজবচন’। এক্ষেত্রে পরম্পরাগত বুদ্ধিজীবীদের কতখানি বাধ্যবাধকতা ছিল, কতখানি আনুগত্য, সেটা তর্ক সাপেক্ষ। তবে হীরক রাজের আদেশকে বাস্তবায়িত করতে জো হুজুর পারিষদেরা কি বিপুল পরিমাণ শক্তি প্রয়োগ করেছিল, সেটা রাজ্য প্রশাসনের গতিবিধি দেখলেই বোঝা যায়।
পারিষদদের না হয় জবাবদিহি করতে হবে, কিন্তু শিল্পীর তো সেই বাধ্যবাধকতা নেই।
এতদসত্ত্বেও, মুসোলিনির বোমারু বিমান যখন আবিসিনিয়ার মাটিতে মুহুর্মুহু বোমা বর্ষণ করছে, তখন সেই নৃশংসতাকে গৌরবান্বিত করার জন্য একজন চিত্রকর যদি তাকে ফুল ফোটার সঙ্গে তুলনা করে ছবি আঁকেন, নিছক চাটুকারিতা বলে সেটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় কি? ফ্যাসিবাদী মতাদর্শকে অন্তর থেকে বৈধতা না দিলে ওই ধরনের একটা ছবি আঁকা সম্ভব! এ ধরনের ঘটনা এ দেশেও ঘটেছে। বৈজ্ঞানিক সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য যাজক এবং শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেছিলেন গ্যালিলিও। সেই অপরাধে রাষ্ট্রশক্তি বিষপ্রয়োগ করে তাকে হত্যা করেছিল। এ রাজ্যের প্রখ্যাত এক নাট্যব্যক্তিত্ব দৃঢ়চেতা সেই গ্যালিলিওকে নিয়েই একটি নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন। অথচ দেশে যখন জরুরি অবস্থা জারি করা হলো, এই মানুষটিই মেরুদণ্ড নুইয়ে শাসকের পক্ষে সওয়াল করে বসলেন! এই উদাহরণগুলো কি নিছক আনুগত্য? বোধহয় নয়, কারণ সভ্যতার ইতিহাসে এই পরম্পরাগত বুদ্ধিজীবীরদের বেশিরভাগটাই শ্রেণি ভারসাম্য পরিবর্তনের কথা বলতে আগ্রহী নন। আসলে শাসকের পক্ষে থাকার মোহগ্রস্ততাই হলো পরম্পরাগত বুদ্ধিজীবীদের চিরায়ত অবস্থান।
বিপরীতে আরেক ধরনের বুদ্ধিজীবী রয়েছেন। যাঁরা এই জগৎ, সমাজকে যেমনটি দেখছেন, হুবহু তার প্রতিফলন ঘটাচ্ছেন নিজের সৃজনশীলতার মধ্যে। শুধু তাই নয়, সাধ্যমত চেষ্টা করছেন মানুষের মধ্যে সমাজ পরিবর্তনের অবদমিত আকাঙ্ক্ষাগুলি উস্কে দিয়ে তাদের সংগঠিত করার, নেতৃত্ব দেবার এবং অবশ্যই তাদের শরিক হবার। চরণ দাসকে কেউ মাথার দিব্যি দেয়নি রাজার বিরুদ্ধে সুর চড়াবার। কিন্তু তার সমাজ সচেতন মন নিজের উপলব্ধিটা প্রকাশ করেছে গানের সহজ ভাষায়- ‘দেখ ভালো জনে রইল ভাঙা ঘরে, মন্দ যে সে সিংহাসনে চড়ে। সোনার ফসল ফলায় যে তার দুই বেলা জোটে না আহার। হীরার খনির মজুর হয়ে কানাকড়ি নাই ...!'
এইখানেই তো ব্যক্তির পরিপূর্ণতা প্রাপ্তি। যেখানে তিনি সামাজিক সমষ্টির সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারছেন। সমাজের সাথে একাত্ম হয়ে, সমাজের একটি অংশ বলে মনে করতে পারছেন বলেই তো তিনি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সুর চড়াচ্ছেন। বলাবাহুল্য, এই সুরই ইতিহাসের ক্রমবিকাশে যূথবদ্ধতা তৈরিতে সহায়ক। এবং কার্যকরী বুদ্ধিজীবীরা সেই ইতিহাস রচনায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে চলেছেন যুগ যুগ ধরে। এবং এই যূথবদ্ধ সমষ্টিই পারে ফ্যাসিবাদ বিরচিত বিমূর্ত সামাজিক সমষ্টির আদলকে ভাঙতে। কাজেই ফ্যাসিবাদের শিকড়কে যদি ঘায়েল করতে হয়, তাহলে এই বিকল্প মতাদর্শ এবং পদদলিত শ্রেণির নিজস্ব সংস্কৃতির প্রচার প্রসার ঘটাতেই হবে। যা অবিরত আক্রমণ হানবে শিকড়ে।
শিকড়ে আঘাত হানার পরিণতি কী হতে পারে, তা যশোর রোডের দুই ধারের অসংখ্য কঙ্কালসার গাছগুলোর দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন। রাজ্যে পরিবর্তনের পর বেশ কিছু গাছ হঠাৎ করে মরতে শুরু করল। বাম আমলে লাগানো বিশালাকার গাছগুলো সাতদিনের মধ্যে নির্জীব হয়ে পড়ছে কীভাবে? বন দপ্তর তদন্তে নেমে দেখতে পেল, রাতের অন্ধকারে কেউ বা কারা গাছের গোড়ায় বিষাক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ করার জন্যেই গাছগুলোর এমন করুণ পরিণতি। অনুপ্রেরণার আশীর্বাদে অপরাধীরা কেউ ধরা পড়েনি ঠিকই। তবে এ ঘটনা একটা শিক্ষা দিয়েছে- শিকড়ে আক্রমণ হানতে পারলে, চিরসবুজ মহীরুহকেও নির্জীব করে ফেলা যায়। কাজেই, পালটা রসসিঞ্চনও করতে হবে শিকড়েই।
Comments :0