Post Editorial on BJP

ক্ষমতার দম্ভ শেষ কথা নয়

সম্পাদকীয় বিভাগ

মণীন্দ্র চক্রবর্তী
কথায় আছে— কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। সেই কর্তা যদি নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হন, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। বস্তুত সেই নিরঙ্কুশ ক্ষমতাসীন হবার সুবর্ণ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে, এ দেশের বর্তমান শাসকদল এবং তার সহযোগীরা যতরকম কুকর্ম এবং দুষ্কর্ম করা যায়, সবক'টিই বাস্তবায়িত করে চলেছে। কর্তার ইচ্ছা হলো- মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে, মন্দির ওখানেই হয়ে গেল। বিরোধিতা করে সাধ্য কার? তিনি যদি বলেন— মার্কশিট, সার্টিফিকেট নেহি দিখায়েঙ্গে, কার ঘাড়ে  কটা মাথা আছে যে, তা প্রকাশ করে? কারণ রাষ্ট্র ক্ষমতা তো তার হাতে। নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী সে। তার এক ছোট্ট ইশারায় গোটা রাষ্ট্রশক্তি রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে যে কোনও মানুষের উপর। অসহনীয় সেই ত্রাসের ভার সইবার ক্ষমতা ক’জনের থাকে! বেশিরভাগ মানুষ সেই ত্রাসের সামনে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। পরিণতিতে যা ঘটে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-
‘ত্রাসে লাজে নতশিরে নিত্য নিরবধি
অপমান অবিচার সহ্য করে যদি                   
তবে সেই দীন প্রাণে তব সত্য হায়
দণ্ডে দণ্ডে ম্লান হয়।... ’
যদিও সত্যের প্রতি লাঞ্ছনা, তাকে পদানত করার অনুশীলন আজকের নয়, চলছে একেবারে প্রাচীন আমল থেকে। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা কার্যকর করা হয়েছে শস্ত্রের জোরে। চিরন্তন সত্য থেকে নীতি- নৈতিকতা, এমনকি শাস্ত্রকেও পড়তে হয়েছে তার আক্রমণের সামনে। বাদ যায়নি রামায়ণ, মহাভারতের মতো মহাকাব্যও। পিতৃসত্য পালনের জন্য রামের চোদ্দ বছর বনবাস। সেই পর্বে রাবণ কর্তৃক সীতা অপহরণ, তাকে উদ্ধারের লক্ষ্যে বানর সেনা নিয়ে রামের লঙ্কা অভিযান, পরিশেষে দশানন রাবণকে বধ করে রামের সীতাকে উদ্ধার— এটাই তো রামায়ণের সার সংক্ষেপ। সাদা চোখে এই কাহিনিতে শাস্ত্রের সাথে শস্ত্রের বিরোধ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু মনুস্মৃতি সাক্ষী, ব্রহ্মহত্যার মতো ক্ষমাহীন এক ভয়ঙ্কর অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল সেদিন রামের হাত দিয়ে। 
মনুসংহিতায় লেখা হয়েছে- 
"ন জাতু ব্রাহ্মণং হন্যাৎ সর্বপাপেষ্বপি স্থিতম্। 
রাষ্ট্রাদেনং বহিষ্কুর্যাৎ সমগ্রধনমক্ষতম্।।" ( ৮/৩৮০) - ব্রাহ্মণ যে কোনও পাপ বা অপরাধই করুক না কেন, রাজা তাকে হত্যা করবে না; বড়জোর সমস্ত ধনের সাথে অক্ষত শরীরে তাকে রাষ্ট্র থেকে নির্বাসিত করতে পারে। এখানেই শেষ নয়, ঠিক তার পরের শ্লোকেই বলা হয়েছে- ‘‘ন ব্রাহ্মণবধাদ্ ভূয়ানধর্মো বিদ্যতে ভুবি। 
তস্মাদস্য বধং রাজা মনসাপি ন চিন্তয়েৎ।।’’ ( ৮/৩৮১) - এই পৃথিবীতে ব্রাহ্মণ বধের তুলনায় গুরুতর অধর্ম বা পাপ আর কিছুই নেই। এই কারণে ব্রাহ্মণকে বধ কিংবা অঙ্গচ্ছেদনাদি করার কথা রাজা কখনো মনে মনেও চিন্তা করবেন না।
যেহেতু সমগ্র মনুসংহিতার মূল সুর ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিষ্ঠা, তাই সেই যুগের সামাজিক ভাষ্য তৈরি হলো— ব্রাহ্মণ অবধ্য। অব্রাহ্মণের হাতে ব্রহ্মহত্যা তো ক্ষমার অযোগ্য, অনিবার্য পরিণতি অনন্ত নরকবাস। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, ব্রাহ্মণ রাবণকে মরতে হলো ক্ষত্রিয় রামের হাতে। কীভাবে ঘটল এটা? শাস্ত্র বিরোধী এই কাজ সমাজ অনুমোদন করল কীভাবে? রাবণকে যতই রাক্ষসরাজ বলা হোক না কেন, রামায়ণের কাহিনি অনুযায়ী রাবণ তো ব্রাহ্মণ। পিতা ছিলেন ব্রহ্ম ঋষি বিশ্রবা, মাতা কৈকেষী। বিশ্রবা আবার মহর্ষি পুলস্ত্য-র (সপ্তর্ষির একজন) পুত্র এবং কৈকেষী হলেন অসুর রাজ সুমালীর কন্যা। কাজেই জন্মসূত্রেই রাবণ বর্ণশ্রেষ্ঠ। উপরন্তু, একাধারে তিনি ছিলেন উপাসক, ধার্মিক, বেদজ্ঞ, সঙ্গীত রচনা এবং বীণা বাদনে যথেষ্ট পটু, অন্যদিকে তিনি ছিলেন বাস্তু এবং জ্যোতিষ সহ দশটি শাস্ত্রে বিশারদ। এহেন পণ্ডিতের হত্যা সমাজ ভালো চোখে নেবে না, তাই রাবণবধকে যুক্তিগ্রাহ্য করার জন্য অজুহাত দেওয়া হলো- রাবণ পরস্ত্রী অপহরণের দায়ে দুষ্ট। যদি তাই হয়, তবে, মহর্ষি গৌতমের রূপ ধারণ করে দেবরাজ ইন্দ্র যখন গৌতম পত্নী অহল্যাকে সম্ভোগ করলেন, সেই অপরাধে তার প্রাণদণ্ড হলো না কেন? রাবণের চাইতে ঢের বেশি অপরাধ করা সত্ত্বেও ইন্দ্রের বেলায় যে সমাজ নীরব রইল, সেই সমাজকে ব্রাহ্মণ রাবণের বিরুদ্ধে অস্ত্র তোলার সাহস জোগালো কোন শক্তি? 
নিশ্চিতভাবেই সেই শক্তির নাম হচ্ছে রাষ্ট্র ক্ষমতা। মনে রাখতে হবে, ইন্দ্র এবং রাবণ কিন্তু সমসাময়িক নন। ইন্দ্রের সময়ে অর্থাৎ বৈদিক যুগে সমাজের একছত্র অধিপতি ছিল ব্রাহ্মণেরা। কিন্তু রামায়ণের যুগ শুরু হবার কিছু কাল আগে থেকেই ক্ষমতার ভারসাম্যে একটা বড়সড় পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। আর্থ-সামাজিক কারণেই ব্রাহ্মণরা একটু একটু করে সমাজে তাদের আধিপত্য হারাতে থাকে। নতুন শক্তি হিসাবে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসতে থাকে ক্ষত্রিয়রা। তবে কৌশলগত কারণে, সমাজ রক্ষক হিসটাবে এতদিন যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে, সেই ব্রাহ্মণদের তারা ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে পুরোপুরি দূরে সরিয়ে দিল না। বরং সমাজের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার প্রাক মুহূর্ত অবধি যথাযোগ্য সম্মান, মর্যাদা এবং প্রতিষ্ঠা দিয়ে তারা ব্রাহ্মণদের পাশে রাখল। রাজনৈতিক ভারসাম্যের এই অভাবনীয় পরিবর্তনটি কত দ্রুত ঘটেছিল, সেটা বোঝার জন্য একটা উদাহরণই যথেষ্ট। পুণ্য অর্জনের জন্য জনক রাজা যাজ্ঞবল্ক্যকে সহস্র গাভী (প্রতিটি গাভীর সিং দুটি ছিল সোনায় মোড়া) দান করতে দেখা গেছে যে রামায়ণে, সেই রামায়ণেই জনক জামাতা রামচন্দ্র সংঘটিত করছেন ব্রহ্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর অপরাধ। রামায়ণের যুগেও যে ব্রাহ্মণকে দেখা গিয়েছিল রাজা এবং জনগণের দানে জীবিকা নির্বাহ করতেন, মহাভারতের যুগে সেই ব্রাহ্মণই পরিণত হলেন রাজকর্মচারীতে। পেটের দায়ে, দ্রোণ এবং কৃপের মতো আচার্যরাও বনে গেলেন বেতনভুক কর্মচারী। ক্ষত্রিয়ের হুকুমকে শিরোধার্য করতে বাধ্য হলেন তারা। 
বলাবাহুল্য, ক্ষত্রিয় প্রতাপে ব্রাহ্মণের সামাজিক প্রতিপত্তি থেকে শুরু করে আধিপত্য এবং মর্যাদা খর্ব হওয়ার ঘটনায় পৃথিবীর গতি সময়ের ভগ্নাংশের জন্যেও স্তব্ধ হয়নি। বরং বিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মকে সঙ্গী করে সময়কে সে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে আরও কয়েক হাজার বছর। পুরানো উৎপাদন ব্যবস্থা ধ্বংস করে সমাজে স্থাপিত হয়েছে নতুন নতুন উৎপাদন সম্পর্ক। যার সর্বাধুনিক রূপ হলো বিশ্বায়িত পুঁজিবাদ। এই পুঁজিবাদের না আছে দেশ-কালের পরিচয়, না আছে কোনও পিছুটান। আছে কেবল অপ্রতিহত, অপ্রতিরোধ্য এবং বেপরোয়া নাছোড় মনোভাব। এহেন প্রবল শক্তিশালী কর্পোরেট পুঁজি এবং তার পাহারাদারদের যদি কেউ চোর বলে দাগিয়ে দেয়, সে সইবে কেন! প্রত্যাঘাত তো করবেই। সেটাই তারা করেছে। এবং সেই দুঃসাহস তারা দেখিয়েছে দেশের সংবিধান এবং যাবতীয় গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে উপেক্ষা করেই। 
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, সংবিধান যদি হয় এ যুগের সংহিতা, তবে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র হলো তার আবশ্যিক পাঠ। কিন্তু গণতন্ত্র বরাবরই শাসকের চক্ষুশূল। কারণ গণতন্ত্র হলো এমন এক ব্যবস্থা যা শাসকের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে বিরুদ্ধতার সুযোগ দেয়, অধিকার দেয় প্রতিবাদ করার, সংগঠিত হবার। এবং ধর্মনিরপেক্ষতা যেহেতু সৌভ্রাতৃত্বের বাতাবরণ গড়ে  তোলে, তাই সমাজে ঐক্য ও শান্তি সুদৃঢ় হয়। সেটা বিজেপি’র মতো চরম হিন্দুত্ববাদী শাসকের কাম্য নয়। কারণ এতে বিভাজনের রাজনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে। কর্পোরেট পুঁজির আক্রমণে জনজীবন যখন বিপর্যস্ত, দেশবাসী যখন এই সর্বনাশা নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছেন, তখন সেই ক্ষোভকে বিপথে পরিচালিত করার জন্য দেশের বর্তমান শাসক এবং তার সহযোগীরা পুঁজির স্বার্থটি সুরক্ষিত রাখার লক্ষ্যে গোটা দেশজুড়ে  বিভাজনের রাজনীতিকে তীব্র করে তুলতে চাইছে। কারণ এটাই আজ তাদের শাসন শোষণের শেষ অস্ত্র। যে কারণে, যারা এর বিরোধিতা করছেন, তাদের উপর নেমে আসছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন। ওদের ধারণা ছিল, আকাশ ছুঁতে চাওয়া লেলিহান শিখাকে যেমন দমকা হাওয়ার দাপটের সামনে মাথা নোয়াতে হয়, তেমনি হয়তো বিরুদ্ধতার সমস্ত শক্তি রাষ্ট্রের দাপটে তাদের সামনে নতজানু হবে, পাগলপারা এলোকেশীর মতো মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রাণ ভিক্ষা চাইবে। কোথায় কী! সাংসদ পদ খারিজ হবার পর, রাহুল গান্ধীর ঘোষণা— ‘আমি সাভারকর নই, ক্ষমা চাইব না।’ ক্ষমা ভিক্ষা চাননি স্ট্যান স্বামী, কাপ্পানেরা। 
ক্ষমতার দম্ভে শাসক হয়ত ভুলে গিয়েছে-বলদর্পী হাওয়ার দাপটে পৃথিবীর পবিত্রতম উপাদান আগুনের শিখা হয়ত কেঁপে ওঠে, হয়তো শঙ্কার প্রহরও সে গোনে। অস্তিত্বের সঙ্কট যখন তাকে গ্রাস করতে থাকে, সেই মৃত্যু ভয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও সে কিন্তু প্রতিমুহূর্তে কামনা করে আরেকটি দমকা হাওয়ার, অপেক্ষায় থাকে ঝোড়ো তাণ্ডবের। যা কিনা অন্তরের মাঝে জিইয়ে রাখা ধিকি ধিকি আগুনটাকে নতুন করে জ্বলে উঠতে সাহায্য করবে। আগুন জানে- যে দমকা হাওয়ার ঝাপটায় প্রদীপের একাকী শিখা নুইয়ে পড়ে ; সেই হাওয়াই কিন্তু ছোট্ট স্ফুলিঙ্গকে লেলিহান শিখায় পরিণত করে দাবানলের জন্ম দিতে পারে, যা দাউদাউ করে জ্বালিয়ে দিতে পারে বিশাল বনভূমিকেও।

Comments :0

Login to leave a comment