প্রবন্ধ
লেনিন-এর সাংবাদিকতা
পল্লব মুখোপাধ্যায়
মুক্তধারা
ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন সমগ্র বিশ্বে একজন রুশ বিপ্লবী, রাজনীতিবিদ এবং
রাজনৈতিক তাত্ত্বিক হিসেবেই পরিচিত। তিনি ১৯১৭ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত
সোভিয়েত রাশিয়ার এবং ১৯২২ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম
ও প্রতিষ্ঠাতা প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর প্রশাসনের অধীনে রাশিয়া এবং
পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে এক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে
পরিণত হয়। আদর্শগতভাবে লেনিন ছিলেন একজন মার্কসবাদী, তাঁর আদর্শের বিকাশ
গোটা দুনিয়া জুড়ে ‘লেনিনবাদ’ নামে পরিচিত। লেনিন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম
উল্লেখযোগ্য এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে ব্যাপকভাবে বিবেচিত এবং বহুল
প্রচারিত। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন-এর অন্যতম স্থপতি তিনি । গোটা
বিশ্বের শোষিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের কাছে লেনিন-এর অর্থ সমাজতন্ত্র,
কমিউনিজম। লেনিন-এর অর্থ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা। লেনিন-এর অর্থ নবযুগের
স্রষ্টা, এক মহান রূপকার। লেনিন-এর বহুমুখী স্বত্তার মধ্যে উদ্ভাসিত তাঁর
সাংবাদিক সত্ত্বা। লেনিন-এর নেতৃত্বে পার্টি স্থির করে "প্রাভদা"; দলীয় মুখপত্র
হবে। পত্রিকাটি ভিয়েনা থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গে স্থানান্তরিত হয় এবং লেনিনের নেতৃত্বে
প্রথম সংখ্যা ১৯১২ সালের ৫ মে প্রকাশিত হয়।
মার্কসবাদী সাহিত্য হিসেবে স্বীকৃত ১৯০২ সালের মার্চে প্রকাশিত "হোয়াট ইজ টু বি
ডান ? বার্নিং কোয়েশ্চেনস অফ আওয়ার মুভমেন্ট" পুস্তিকার পঞ্চম অধ্যায়ে লেনিন
বলছেন, একটি সংবাদপত্র শুধু "যৌথ প্রোপাগান্ডিস্ট বা যৌথ আজিটেটোর" নয়, যৌথ
সংগঠকও বটে। সাংবাদিকতা শুধু নয়, সংযোগ বা জ্ঞাপন প্রক্রিয়ার আর্থ সামাজিক ও
রাজনৈতিক অবস্থান নির্ণয়ে লেনিন-এর মূল্যায়ন আজও অভ্রান্ত। লেনিন বুঝিয়েছেন
কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র কীভাবে ও কেন "যৌথ সংগঠক" হয়ে ওঠে। কীভাবেই বা
রচিত হয় গণমাধ্যমের গণতান্ত্রিক ভূমিকার জন্য সক্রিয় উদ্যোগের মতাদর্শগত ও
সাংগঠনিক ব্যূহ বিন্যাস। লেনিন-ই সোচ্চার হয়েছিলেন বুর্জোয়া সাংবাদিকতার
অবক্ষয়ের শ্রেণীচরিত্র সম্পর্কে। কীভাবেই বা সমাজবাস্তবতায় কমিউনিস্ট পার্টির
পত্র-পত্রিকাকে ভূমিকা পালন করতে হয়। ১৯০২ সালের মার্চে প্রকাশিত এই
পুস্তিকার প্রথম ইঙ্গিত লেনিন দিয়েছিলেন ১৯০১ সালের মে মাসে, "ইস্ক্রা"-র চতুর্থ
সংখ্যায় প্রকাশিত "কোথায় শুরু করতে হবে" প্রবন্ধে।
১৯২১ সালের জুন-জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের তৃতীয়
কংগ্রেসে লেনিনের নেতৃত্বে রচিত হয় পার্টি মুখপত্র সম্পর্কে গাইডলাইন। সেই
প্রস্তাবে স্পষ্ট বলা হয়েছিল, কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা কমিউনিস্টদের বিপ্লবী
কাজের শ্রেষ্ঠ সংগঠক হয়ে উঠবে। কমিউনিস্ট পত্রিকাকে একটি কমিউনিস্ট সংগঠন
হয়ে ওঠার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। হয়ে উঠতে হবে একটি "প্রলেতারীয় সংগ্রামী
সংগঠন"।
লেনিনই প্রথম সর্বহারার নিজস্ব পার্টির সাংগঠনিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে
প্রচারকার্য ও প্রচারব্যবস্থা পরিচালনার বিষয়টিকে সূত্রবদ্ধ করেছিলেন।
রাজনৈতিক, সামাজিক ঘটনাপ্রবাহে কীভাবে পার্টি সংবাদপত্র হস্তক্ষেপ করার
সামর্থ্যকে শাণিত করবে তার তত্বায়নের সূত্রপাত করেন লেনিনই।
বস্তুত, এজিটেশন ও প্রোপাগান্ডার বিষয়টি লেনিন-এর চেতনায় বিশেষ রাজনৈতিক
সাংগঠনিক মাত্রা অর্জন করেছিল। তিনি "প্রোপাগান্ডা" ও "এজিটেশন"-এর ধারণা ও
নীতিগত ব্যাখ্যা দেন। কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদপত্র বা প্রকাশনা লেনিন-এর চেতনায়
নিছক এজিটেশন বা প্রোপাগান্ডার মাধ্যম নয়। তা "যৌথ সংগঠক"। ব্যক্তির সচেতন ও
সক্রিয় রাজনৈতিক ভূমিকার প্রশ্নটি জ্ঞাপন প্রক্রিয়া ও তার বিষয়বস্তুর সঙ্গে
সম্পৃক্ত। পার্টি মুখপত্র কতখানি যৌথ সংগঠক হয়ে উঠতে পারল তার ওপরই
প্রোপাগান্ডা ও এজিটেশন-এ তার কার্যকারিতা নির্ভর করবে। লেনিন-এর মতে,
প্রোপাগান্ডার লক্ষ্য তুলনামূলকভাবে কম মানুষ, যাদের কাছে একটি বা নির্দিষ্ট
কয়েকটি বিষয় নয়, বহু বিষয় (যা অবশ্যই পরস্পর সম্পর্কিত) উত্থাপন করা হয়।
উপস্থাপিত করা হয় ঘটনার বিশদ তাত্বিক ব্যাখ্যা। এজিটেশন-এর ক্ষেত্রে
জনসাধারণের কাছে তুলে ধরা হয় কোনও একটি প্রকট ও স্পষ্টবোধ্য বিষয়।
প্রোপাগান্ডার কাজ মূলত মুদ্রিত শব্দের সাহায্যে অর্থাৎ পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে।
আজিটেটোর প্রধানত বক্তা।
কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র তাই সামাজিক রূপান্তরের সংগ্রামে বিকল্পহীন। অন্য
কোনও সংবাদমাধ্যম এর সঙ্গে তুলনীয় নয়। হতে পারে না। সাংবাদিকতা পেশাকে
জনমুখী করার নিরলস প্রয়াসে ব্রতী লেনিন অপরাজেয়।
Comments :0