গল্প
মুক্তধারা
-----------------------------
পথরেখা
-----------------------------
রাহুল চট্টোপাধ্যায়
রামতনু বাবু হাঁটতে পারেন না।
তেভাগার সময় লাঠির আঘাতে পা দুটো জখম হয়েছিল।আজ এতবছর পরেও সেই ঘা রয়ে গিয়েছে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যথা বেড়েছে। ব্যথা স্মৃতি রেখে গেছে সেই গণজাগরণের।
সেবার চন্দনপিঁড়িতে জমির মাঝে কয়েকশো লোক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। পিঠে ফেলা গামছাটা মাথায় বেঁধে নিয়ে হাতের লাঠিটা শক্ত করে তেড়ে গিয়েছিলেন জোতদার আর পুলিশের লোকগুলোর দিকে। হৈ হৈ করে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষেরাও দৌড়ে ছিল। পাল্টা আঘাতে পড়ে গিয়েছিলেন। মাথা ফেটে রক্ত বেরিয়েছিল,পা দুটো প্রচন্ড আঘাতে নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল। ধরাধরি করে বাড়ি নিয়ে এসেছিল সেদিনের সঙ্গীরা। সেই থেকেই পা দুখানায় জোর চলে গেল।লাঠি ভর করে উঠে দাঁড়ানো,এক-পা দু-পা করে হাঁটাচলা,ঐ পায়ে ভর করে একটু ঘরের বাইরে এসে বসা।
এমন ভাবেই কেটেছে বছরের পর বছর। তেমন চিকিৎসা সেকালে ছিল না।আর আর্থিক সঙ্গতিও নেই।বাড়িতে বসেই গ্ৰামের মানুষের খোঁজ খবর রাখা,সমস্যাগুলো নিয়ে পরামর্শ দেওয়া চলতেই থেকেছে । মানুষের মাঝখানে বেঁচে থাকাটাই তাঁর ভালোলাগা।
তেভাগা আন্দোলনের দিনগুলোর কথা মাঝেমাঝেই বলতে থাকেন রামধনু বর্মন। তখন যে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলেন, আজও তা ধিকি ধিকি জ্বলে। বর্তমানের বুকে অবিশ্বাস্য সংকট বড়ো ব্যথা দেয় তাঁকে। তেভাগার ময়দানে হিন্দু মুসলমান ছিল না। উঁচু নীচু ছিল না।এক অদ্ভূত ভাই ভাই সম্পর্ক নিয়ে জমির লড়াই লড়েছেন তাঁরা।দেশটা ভাগ হলেও জীবনটা ভাগ হয় নি। মেয়ে,বউ ছেলে,বাপ একসঙ্গে লড়াই করেছে। জমি রক্ষা করেছে,সমাজ রক্ষা করেছে।আজকের সময়টা কেমন হয়ে গেছে! বিস্ময় লাগে রামতনুবাবুর।
এসব ভাবতে ভাবতে পা টা দু-হাত দিয়ে সোজা করে একটু টানটান করে বসেন তিনি ।শীতের দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসে।নাত-বৌ এসে চা দিয়ে যায়। তক্তাপোষে বসে সামনের জানলার বাইরেটা দেখেন।সূর্যের শেষ আলোটুকু কেমন চুঁইয়ে বটগাছটার নীচে নেমে এসেছে।বড়ো কোটরে পাখিটার ফিরে এসেছে।মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়।দূর থেকে নানা শব্দের মধ্যে ভেসে আসতে থাকে মানুষের গলার আওয়াজ।সে আওয়াজ ক্রমেই কাছে আসতে থাকে। এক সময় তার ঘরের সামনে দিয়ে এগিয়ে যায়। নতুন ছেলে মেয়েরা চলেছে। নতুন বাংলা চায় ওরা। মানুষের জন্য বাংলা।
চোখদুটো চক্চক্ করে ওঠে রামতনুবাবুর।
Comments :0