মুক্তধারা
গল্প
অনিল - আনন্দের ভাষা
------------------------
সুকান্ত পাল
------------------------
২৩ অক্টোবর ২০২৫, বর্ষ ৩
সকাল ন'টা বেজে পনেরো। বাজার করে, এক হাতে সবজির ব্যাগ অন্য হাতে মাছের ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি বড় রাস্তার উপর। টোটোর জন্য অপেক্ষা।
ছোটবেলা থেকে ঠাকুমার বকাঝকায় সেই যে সবজি আর মাছের ব্যাগের মধ্যে ডিভোর্স ঘটিয়ে দিয়েছে তার ট্র্যাডিশন সমানে এখনো চলছে। কখনো কোনো অবস্থাতেই এই দুটিকে জুটি বাঁধতে দেওয়া যাবে না। যায়ও নি। অগত্যা দুটি ব্যাগ দুই হাতে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখি আমার সামনে আমাদের বাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজোর পার্মানেন্ট ঢাকি অনিল সাইকেল থেকে নামল।
দুই ঠোঁটের এক্কেবারে শেষ কোণা পর্যন্ত যতটা বিস্তার করা যায় ঠিক ততটাই ছড়িয়ে দিয়ে জেব্রা ক্রসিং এর মতো বিড়ি খাওয়া দাঁত বের করে বলল,
-- বাজার হয়ে গেল?
-- হ্যাঁ, হয়ে গেল তো।
-- বাড়ি যাচ্ছেন ?
-- হ্যাঁ। কেন বলো তো?
-- আমি আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম।
-- কেন ? কি দরকার? আমাদের পূজো তো এখনো দেরি আছে। আর তাছাড়া তোমাকে তো আর বলতে হয় না। তুমি আর আনন্দ তো পূজোর দুদিন আগেই দেখা করে যাও।
আমার কথা শুনে অনিল মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,
-- না, দাদাবাবু, আপনাদের বাড়ির পূজোর ব্যাপারে না।
-- তবে!
---আপনাদের পাড়ার দূর্গাপূজোটা বেশ বড় করেই হয়। তাই বলছিলাম ..
-- কি? বলো..
-- আপনি যদি কমিটিকে বলে একটু ব্যবস্থা করে দেন।
--কি ব্যবস্থা ? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
-- এবারে পূজোয় ঢাকের বায়নাটা যদি আমাকে দেয় তাহলে খুব ভালো হয়।
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এর আগে আমাদের বাড়িতে ওর ঢাকের বাজনা শুনে পাশের চক্রবর্তী বাড়ির লোকেরা তাদের বাড়ির কালী পূজোয় অনিলের কথা বলেছিল। সেই মতো আমি অনিলকে বলেছিলাম। কিন্তু অনিল রাজি হয় নি। কারণ অনিল আর আনন্দ দুজনে মিলে আজ প্রায় বছর কুড়ি ধরে মধ্যপ্রদেশের, এখন ছত্তিশগড়ের ভিলাই আর রায়পুরে চলে যায় ঢাক বাজাতে। তৃতীয়ার দিন ট্রেন ধরে ওখানে চতুর্থী থেকে শুরু করে একেবারে কালীপূজো সেরে বাড়ি ফেরে। ঐখানে ওদের বাঁধা বাড়ি আছে। এছাড়াও প্রবাসী বাঙালিরা কোজাগরী লক্ষ্মী পূজো করে। তখন সেই লক্ষ্মী পূজোতে কম করে পাঁচ ছ' খানা বাড়িতে দুজনে মিলে ভাগাভাগি করে ঢাক বাজায়। বেশ ভালো রোজগার হয় ওদের দুজনের।
এই কারণেই অনিল- আনন্দ জুড়িকে গুপ্তিপাড়ার মানুষ মাথা কুটলেও বাজনার জন্য বায়না নেওয়াতে পারে না। আবার পাল বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পূজোতে বংশানুক্রমিক ভাবে ওরা ঢাক বাজায় বলে অনেকেরই একটু ঝাল লাগে। কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই। ওর বাপের আমল থেকে ওরা আমাদের বাড়িতে ঢাক বাজিয়ে আসছে। তাই একটু অবাক হয়েই বললাম,
-- কেন এবার রায়পুরে যাবে না?
-- না, ঠিক সাহস পাচ্ছি না। তাছাড়া বাড়ির মানুষটার একদম মত তো নেইই তার উপর সে তার মাথার দিব্যি দিয়ে বসে আছে।
আমি যারপরনাই আবাক হয়ে যাই। জিজ্ঞাসা করি,
-- কারণটা কি শুনি। এতোদিন ধরে যাদের বাড়িতে ঢাক বাজিয়ে আসছ হঠাৎ করে তাদের ছেড়ে দেবে! একদিন তো তোমরা আমাদের বাড়ির ঢাক বাজানোও হুট করে ছেড়ে দেবে মনে হয়।
-- না, দাদাবাবু তা নয়।
-- তবে কি ? একটু খোলসা করে বলো তো।
আমার কথায় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
-- আমরা তো বাঙলাতেই কথা বলি।
-- হ্যাঁ, তাই তো বলবে। এ আবার নতুন কথা কি ?
-- না, মানে এখন অবস্থা তো ভালো নয় , তাই।
-- ঠিক বুঝলাম না।
--ঐখানে গিয়ে বাংলায় কথা বললে যদি আমাদের আবার বাংলাদেশী বলে জেলে ঢুকিয়ে দেয় তখন কি হবে?
আমার বুঝতে একটু সময় লাগলেও অনিলের কথায় এক গভীর কালো মেঘের যেন আভাস পাওয়া গেল।
কিন্তু এই কালো মেঘকে উড়িয়ে দেবার মতো ঝড়ের দাপট কোথায়?
এই ভীতি যত বাঙালির উপর চেপে বসবে ততই তো সুবিধাবাদীদের সুবিধা!
এই ভীতিকে জীবন সঙ্গী করে বাঁচা আত্মহত্যার সামিল।
ভারতবর্ষ আমার দেশ। আমার দেশের যত্রতত্র আমি বিচরণ করতে পারি এবং করব। বাংলা আমার মাতৃভাষা ভারতবর্ষের যেকোনো প্রান্তে বসে নিশ্চিন্তে, নির্ভয়ে আমার মাতৃভাষায় কথা বলব। যেমন আমার বাংলায় বসে ভারতবর্ষের অন্যান্য ভাষাভাষীরা নিশ্চিন্তে এবং নির্ভয়ে তাদের মাতৃভাষায় কথা বলে। এটা তাদের ভারতবাসী হিসাবে অধিকার এবং আমারও অধিকার।
একই দেশের, একই সংবিধানের অধীন সব নাগরিকদের অধিকার একই হয়।
অনিল- আনন্দের ভাষাও সেই অধিকারের মধ্যেই পড়ে।
Comments :0