আল থুমামা স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে নিথর হয়ে পড়েই গেলেন মরক্কোর জনপ্রিয় কমেডিয়ান ওসুমে রামজি। তাঁর মুখে কোনও বাক্য নেই। গোটা স্টেডিয়াম গর্জনে কেঁপে কেঁপে উঠছে। রাবাত থেকে কাতারে আসা লুবনা বলেই চলেছেন, ‘প্রথম বার প্রথম বার। ইতিহাস তৈরি হলো। আদিয়োস স্পেন, আদিয়োস পর্তুগাল, এবার যে আসবে তাকেও বিদায় দেব। আমরা জিততে পারি’।
 
শুধু স্টেডিয়ামে নয়, শুধু দোহাতে নয়, এমনকি শুধু মরক্কোর শহরগুলিতে নয়। পর্তুগালকে হারিয়ে মরক্কোর সেমিফাইনালে ওঠা একসূত্রে গেঁথে দিয়েছে পুরো আফ্রিকা এবং আরব দুনিয়াকে। 
মাঘরেব বা পশ্চিম আফ্রিকার মরক্কো ভূগোলে যেমন আফ্রিকা, সংস্কৃতিতে তেমন আরব। সীমানা ছাড়িয়ে মরক্কোর জয়ের উৎসব চলছে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সিরিয়া পর্যন্ত। আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ম্যাকি সল টুইটারে নিজের আনন্দ প্রকাশ করতে বড় হাতেই লিখেছেন, ‘ঐতিহাসিক! অকল্পনীয়! ব্রাভো মরক্কো’।
লিবিয়া, ইরাক, প্যালেস্তাইন অথরিটির প্রধানমন্ত্রীরা, বাহরিন, সংযুক্ত আরব আমীরশাহীর শাসকরা অভিনন্দন জানিয়ে টুইট করেছেন। আইভরি কোস্টের প্রাক্তন নক্ষত্র দিদিয়ার দ্রোগবা লিখেছেন, ‘ওরা পেরেছে! আফ্রিকা দীর্ঘজীবী হোক’। ক্যামেরুনের রাস্তায় পতাকা হাতে নেমে পড়েছেন জনতা। ক্যামেরুনের বিদায়ের শোক ভুলে। লিবিয়ার বন্দর শহর মিসরাতায় লাল রঙের আতশবাজির সঙ্গে লিবিয়া ও মরক্কোর জাতীয় পতাকা হাতে সারা রাত উৎসব করেছেন মানুষ। তিউনিসে ম্যাচ দেখে আপ্লুত আমিউর সৌলাম বলেন, ‘ আজ মরক্কো আফ্রিকান ও আরবদের গর্বিত করেছে। যে স্বপ্ন আমাদের সকলের ছিল তা সফল করেছে।’
আগের ম্যাচের শেষে মরক্কোর খেলোয়াড়রা প্যালেস্তাইনের পতাকা হাতে জোরালো বার্তা দিয়েছিলেন। পর্তুগালের বিরুদ্ধে ম্যাচের দিন প্যালেস্তাইন জুড়ে, এমনকি ইজরায়েলের আরব বাসভূমি এলাকায় হাজার হাজার মানুষ খেলা দেখেন। ইউসুফ এন-নেসরির গোলের পরেই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছিলেন তাঁরা। মরক্কো জেতার পরে প্যালেস্তাইনে এমন উৎসব শুরু হয় যেন তারাই জিতেছে। কাতার-সহ মধ্য প্রাচ্যে মরক্কোর প্রচুর মানুষ পরিযায়ী শ্রমিক। মরক্কোর খেলোয়াড় জাওয়াদ এল ইয়ামিক ম্যাচের পরে অর্ধেক কাতার- অর্ধেক মরক্কোর পতাকা জড়িয়ে মাঠ পরিক্রমা করেন। এই দৃশ্য ইতিহাসকে ফ্রেমবন্দি করে রাখার মতোই।
উৎসবের এখানেই শেষ নয়। বেলজিয়ামে প্রচুর মরক্কোর মানুষ থাকেন। বেলজিয়ামকে মরক্কো হারানোর পরে তাঁরা আনন্দ করার সময়ে দাঙ্গা বেধে যায়। কিন্তু শনিবার আবার রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন মরোক্কানরা। লন্ডনের এজওয়ার ডিস্ট্রিক্ট আরব সম্প্রদায়ের অন্যতম কেন্দ্র। সেখানে পতাকা নিয়ে মানুষের উল্লাস এবং গাড়ির হর্নের আওয়াজ মিলেমিশে যায়। প্যারিসের সাঁজে লিজেতে জনস্রোত তৈরি হয়ে যায়। 
                        
                        
সেমি ফাইনালে উঠে হতবাক করে দেওয়া মরক্কো কিন্তু তৈরি হয়েছে অনেক আগে থেকেই। এই বিস্ফোরণের অন্যতম কারণ প্রবাসী মরক্কোর খেলোয়াড়দের খুঁজে বের করে তাঁদের নিয়ে দল বানানোর পরিকল্পিত নীতি। ইউরোপেই প্রায় ৫০ লক্ষ মরক্কোর অভিবাসী থাকেন। তাঁদের বেশির ভাগেরই সঙ্গে স্বদেশের যোগাযোগ রয়েছে। মরক্কোর বিশ্বকাপ স্কোয়াডের ২৬ জনের ১৪ জনই জন্মেছেন দেশের বাইরে। এই প্রতিযোগিতায় সব দলের মধ্যে এই সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ইউরোপে ছড়িয়ে থাকা অভিবাসী অংশের মধ্যে থেকে দল তৈরি নতুন জমি খুলে দিয়েছে। 
এখনও পর্যন্ত প্রতিযোগিতায় একটি মাত্র গোল খেয়েছেন গোলরক্ষক ইউনিস বোনু। তাঁর জন্ম কানাডায়। রাইট ব্যাক আসরাফ হাকিমির জন্ম মাদ্রিদে। মাঝমাঠের সোফিয়ান আমরাবাত জন্মেছেন নেদারল্যান্ডসে, বাঁ প্রান্তের সোফিয়ান বুফোলের জন্ম ফ্রান্সে। মরক্কোর ফুটবল ফেডারেশন ইউরোপে প্রতিভা খুঁজে বের করার জন্য স্কাউট পাঠায়। যেখানে স্বদেশ না বাসভূমি এই দ্বন্দ্ব সামনে আসার সম্ভাবনা থাকে, সেখানে দ্রুত কথা বলে খেলোয়াড়দের সঙ্গে। আসরাফ হাকিমি যেমন স্পেনের হয়ে খেলার বদলে বেছে নিয়েছেন মরক্কোকে, তেমনই হাকিম জিয়েচের সঙ্গে কথা হয়েছিল নেদারল্যান্ডসের। শেষ পর্যন্ত জিয়েচ বেছে নিয়েছেন মরক্কোকে। জিয়েচের মতোই জুনিয়র পর্যায়ে আমরাবাত খেলেছিলেন নেদারল্যান্ডসের হয়ে। কিন্তু ‘মরক্কোর টানই আলাদা’, বলেছেন তিনি।
একেবারে বিনা বিতর্কে এ ঘটনা ঘটেনি। প্রশ্ন উঠেছিল, এইভাবে বিদেশে জন্মানো বা সেখানেরই বাসিন্দা খেলোয়াড়দের জায়গা দিলে দেশের খেলোয়াড়দের সুযোগ সঙ্কুচিত হবে। মরক্কোর কোচ ওয়ালিদ রেগ্রাগুই বলেছেন, ‘‘ বিশ্বকাপের আগে এ নিয়ে অনেক সমস্যা হয়েছিল। অনেক সাংবাদিক প্রশ্ন করতেন কেন শুধু মরক্কোয় জন্মানো খেলোয়াড়দের নিয়েই দল তৈরি হবে না? আজ আমরা দেখিয়ে দিয়েছি সব মরোক্কানই মরোক্কান। জাতীয় দলে যখন আসে তখন তারা মরতে প্রস্তুত থাকে, লড়তে প্রস্তুত থাকে।’’ রেগ্রাগুই নিজে ফ্রান্সে জন্মেছেন। 
অনেক দিন এমন বিশ্বজোড়া আনন্দের উৎসব দেখা যায়নি। সাধারণত ব্রাজিলের জয়ে সীমান্ত-ভাঙা এমন দৃশ্য দেখা যেত।
 
                                        
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
Comments :0