WATER LOGGING

ডুবলো শহর তৈরিই হয়নি জল রিচার্জ প্রকল্প, ভাঙা হয়নি বেআইনি নির্মাণ

কলকাতা

 

নিজস্ব প্রতিনিধি: কলকাতা, ২৪ সেপ্টেম্বর— বৃষ্টির জল দিয়ে ভূগর্ভস্থ জলের রিচার্জ করার পরিকল্পনা কার্যকরী না করার জেরেই কার্যত ভুগতে হচ্ছে শহরবাসীকে। বৃষ্টির জমা জলের নিকেশ করতে শহরে ৫০ জায়গায় বসানোর কথা ছিল কূপ। বৃষ্টির জল দিয়ে  ভূ-গর্ভস্থ জলের রিচার্জ করাই উদ্দেশ্য ছিল। ভূগর্ভস্থ জলতলের মাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে কলকাতায় বন্যা নিয়ন্ত্রণে তৈরি হয়েছিল সেই নীল নকশা। ন্যাশনাল ডিজাস্টার রিডাকশন ম্যানেজমেন্ট অথরিটি (এনডিআরএমএ) প্রকল্পের সব টাকা দিতে রাজিও ছিল।
ওয়াটার পকেট হিসাবে ৫০টি জায়গা চিহ্নিত করেছিল কর্পোরেশন। যেখানে ফাইবারের ইকো ব্লক বসানোর কথা ছিল। মাটি কেটে এই বক্স মাটির নিচে বসানোর পরিকল্পনা ছিল। বক্সের নিচের অংশে কূপের মতো করে ৩০ মিটার গভীরে পাইপ ঢোকানো হবে। কলকাতায় মাটির নিচে ২৮-৩০ মিটার গভীরে একটি বালির স্তর রয়েছে। যেখানে পানীয়জলের স্তর আছে সেখানে সরাসরি নয়, উপরে বালি স্তরে জল ফেলা হবে। যখন বৃষ্টি হবে তখন জিও ব্লকের মাধ্যমে জল যাবে কূপ মারফত। জমা জল এইভাবে শোধনের উদ্দেশ্য ছিল।  
এক একটি ইকো ব্লক জল ধারণের ক্ষমতা ৫০ হাজার লিটার। এই ইকো ব্লক বসাতে ৭ মিটার দৈর্ঘ্য, ৪ মিটার প্রস্থ জায়গা লাগবে, যার গভীরতা হবে ২ মিটার। এক একটি ইকো ব্লক বসাতে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা খরচ। ১৫ কোটি টাকা ন্যূনতম খরচ হতো ওই প্রকল্প বাস্তবায়নে। সেই টাকা দিতে প্রস্তুতও ছিল ন্যাশনাল ডিজস্টার রিডাকশন ম্যানেজমেন্ট অথরিটি।
মূলত যেখানে বেশি জল জমার প্রবণতা সেখানেই এটা করার কথা ছিল। মাটি পরীক্ষা হয়েছিল কিন্তু সেই ইকো ব্লক আর হলো না। চেন্নাইতে ভূ-গর্ভস্থ জলের পরিমাণ ঠিক রাখতে এই ধরনের প্রকল্প দীর্ঘদিন ধরেই আছে। মুম্বাইয়ে হয়েছে এমন ব্যবস্থা। আর তার জেরে এবছর একদিনে ৪০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হলেও তা শুষে নিতে ছয় ঘণ্টা লেগেছিল।
ওই রিচার্জ প্রকল্প খাস কলকাতার ভূগর্ভস্থ জল ভাণ্ডারের সঙ্কট কমাতে পারতো। আগে কলকাতায় জলস্তর ছিল মাটির ১০-১৫ ফুটের নিচে। দ্রুত গতিতে নগরায়ন আর জলাশয় বুজিয়ে দেওয়ার জেরে ভূ-গর্ভে আর জল ঢুকতে পারছে না। আর তাতে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে রিচার্জ। জলস্তর হু হু করে নেমে যাচ্ছে। গরমকালে এখন কলকাতার জলতল ৫০ ফুটের নিচে চলে যাচ্ছে।
এর পাশাপাশি কলকাতায় অনেক পুকুর ছিল। এর মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ জল রিচার্জ হতো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।  মাটির নিচের স্তরগুলিতে জল না থাকায় সেগুলো ফাঁপা হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে। সমুদ্রের জলস্ফীতি ঘটায় দ্রুত মাটি সেই জল টানছে ৷ তাই পানীয় জলের বদলে লবণাক্ত জল সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে। ফলত শুধু জমা জল নিকাশ শুধু নয়, আগামীদিনে নিদারূণ পানীয় জলের সঙ্কটে পড়বে শহর। কলকাতা কর্পোরেশন ট্রেন্ডার বিভ্রাটের জেরে সেই প্রকল্প এখন বিশ বাঁও জলে।
এর সঙ্গে জমা জলের সবচেয়ে বড় ভাণ্ডার পূর্ব কলকাতা জলাভূমি আজ জমি মাফিয়াদের কবলে। সায়েন্স সিটি ছাড়িয়ে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস থেকে কিছুটা এগিয়ে ওই প্রাকৃতিক জলাশয়। প্রায় ১২৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত এই জলাভূমি আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত। কলকাতা শহরের দূষিত নোংরা জল এখানে এসে জমা হয়। তারপর সেটা প্রাকৃতিক ভাবে শোধিত হয়। কিন্তু কোনও সময় যদি পুরো জলাভূমিটাই গায়েব হয়ে যাচ্ছে। সকলেই এটা জানলে প্রতিকার এক চুলও হয়নি।  
ওই পূর্ব কলকাতা জলাভূমিকে বাঁচিয়ে রাখতে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই চালাচ্ছেন বিভিন্ন পরিবেশ কর্মী ও সংগঠন। জলাভূমি ভরাটের বিরুদ্ধে আদালতে বেশ কয়েকটি মামলাও করেছেন পরিবেশকর্মী বনানী কক্কর।  তাঁর কথায়, ‘পূর্ব কলকাতা জলাভূমি বুজিয়ে যেভাবে একের পর এক বেআইনি নির্মাণ হচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে এখানে আর জলের চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যাবে না। এর ফল ভুগতে হবে কলকাতার মানুষকে।’
গত বছরের ডিসেম্বর মাসে কলকাতা হাইকোর্টে রাজ্য সরকারের তরফ থেকে যে হলফনামা জমা পড়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, পূর্ব কলকাতা জলাভূমি এলাকায় এখনও পর্যন্ত ৫০০টি বেআইনি নির্মাণ চিহ্নিত করতে পেরেছে প্রশাসন। তার মধ্যে ৫২টি ভেঙে ফেলার আদেশ দিয়েছে আদালত। কিন্তু সেই কোনও নির্দেশই কার্যকর হয়নি। শুধু পূর্ব কলকাতার জলাভূমি নয়, গোটা শহর জুড়েই পুকুর ও জলাশয় ভরাট করে বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে। কর্পোরেশনের হিসাব বলছে, কলকাতা থেকে প্রায় পাঁচ হাজার পুকুর ও জলাশয় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। সবথেকে বেশি পুকুর ভরাট হয়েছে কলকাতা কর্পোরেশনের সংযোজিত এলাকায় (১০০-১৪৪ ওয়ার্ড)। 
এর শীর্ষে রয়েছে গার্ডেনরিচ, যাদবপুর, বেহালা এবং টালিগঞ্জ। কলকাতা শহরে কতগুলো পুকুর ভরাট হয়েছে তার উপর একটি সমীক্ষা করেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজ্য জলসম্পদ দপ্তর এবং তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগ। সেই সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৪ সাল থেকে ২০২২সালের মধ্যে শুধু গার্ডেনরিচ ও মেটিয়াবুরুজ এলাকার পাঁচটি ওয়ার্ডে মোট ২৭০টি পুকুর বোজানো হয়েছে। যার অধিকাংশ ভরাট হয়েছে গত দশ বছরে। 
কর্পোরেশনের আধিকারিকদের মতে, ‘বাস্তু জমির তুলনায় পুকুর অনেক কম পয়সায় কিনতে পাওয়া যায়। পুকুর ভরাট করে বাড়ি বানাতে পারলে প্রোমোটারদের লাভ বেশি হয়। সেই কারণেই এক শ্রেণির অসাধু প্রোমোটার পুকুর ভরাট করতে পিছপা হচ্ছে না। তৃণমূলের নেতারা ওই অসাধু প্রোমোটারের সুরক্ষার কাজ করছে। পুকুর ভরাট করে তৈরি হওয়া গার্ডেনরিচে বাড়ি ভেঙে পড়ার ঘটনার পর নড়েচড়ে বসেছিল কলকাতা কর্পোরেশন। পুকুর ভরাট হচ্ছে কি না, তার উপর নজর রাখতে ১০ সদস্যের কমিটি তৈরি করা হয়। ঠিক হয়েছিল, পুকুর ভরাট সংক্রান্ত যত অভিযোগ আসবে তা প্রতি মাসে পর্যালোচনা করব কমিটি। তার ভিত্তিতে পদক্ষেপ করবে কর্পোরেশন।

Comments :0

Login to leave a comment