SIKKIM FLOOD

সিকিম থেকে বিপদ সঙ্কেত

সম্পাদকীয় বিভাগ

sikkim tragedy bengali news editorial

উত্তর সিকিমের ১৭০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত লোনাক হ্রদে মেঘ ভাঙা বৃষ্টির জল প্রবল বেগে তিস্তা দিয়ে বয়ে এসে যে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ঘটিয়েছে তা এক কথায় অভাবনীয়। পশ্চিম হিমাল‍‌য়ের উত্তরাখণ্ড এবং হিমাচল প্রদেশে এবছর যে ভয়াবহ প্লাবন ধস দেখা গেছে তারই সম্প্রসারিত রূপ গত মঙ্গলবার উত্তর সিকিমের ঘটনা। পাহাড়ি রাজ্য সিকিমের তিনটি জেলাকে কার্যত তছনছ করে দিয়েছে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়। বেশ কয়েকটি ব্রিজ, বাঁধ ভেঙে নিশ্চিত হয়ে গেছে। স্বাভাবিকের থেকে কম করে ১৫-২০ ফুট উঁচু দিয়ে তিস্তার খরস্রোত দু’কূলে চালিয়েছে ধ্বংসলীলা। কত গাড়ি বাড়ি যে ভেসে গেছে, তলিয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। পাহাড়ে জলের তোড়ে ভেসে যাওয়া মানুষের মৃতদেহ ভেসে উঠছে জলপাইগুড়ির সমতলের তিস্তায়। প্লাবন এতটাই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে যে গোটা একটা সেনা শিবিরই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বহু গ্রাম-শহর-‍‌লোকালয়ে শুধু ধবংসের ছবি। সড়ক ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। হাজার হাজার পর্যটক আটকে পড়েছে। সিকিমে এমন এক ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয় সাম্প্রতিককালে দেখা যায়নি।
শুধু সিকিম নয়‌, গোটা হিমালয় অঞ্চলে অতীতে কদাচিৎ বড় ধরনের প্রাকৃতি বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটলেও গত দেড়-দু’দশকের মধ্যে তা বাড়ছে। সংখ্যায় যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে ভয়াবহতায়। প্রকৃতিকে পোষ মানানোর মানুষের আগ্রাসী পদক্ষেপ প্রতিশোধ আকারেই যেন ফিরিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতি। তথাকথিত উন্নয়নের ধাক্কায় পাহাড়ে ভূমিস্তর ও ভূমি বিন্যাসে ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। পাহাড় কেটে হচ্ছে রাস্তা। পাহাড়ের ঢাল হচ্ছে বড় বড় বাড়ি। অতিরিক্ত চাপ সহনশীলতাকে অতিক্রম করছে। বাড়ছে জনবসতি। বন কেটে সাফ হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে ভারসাম্য। নদীতে বাঁধ দিয়ে বড় বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প হচ্ছে। পদে পদে বাধা পাচ্ছে নদীর স্বাভাবিক স্রোত। তাই বিপর্যয় অস্বাভাবিক কিছু। ক্রমে এমন বিপর্যয় যে বাড়তেই থাকবে সেটাও প্রায় নি‍‌শ্চিত।
আসলে জলবায়ু পরিবর্তন, ভূ-উষ্ণায়ন ইত্যাদির জেরে পাহাড়ের বুকে গ্লেসিয়ারের সরন ও গলন বৃদ্ধি পেয়েছে। শীতকালীন বরফ আচ্ছাদিত অঞ্চলের পরিসর কমছে। উঁচু অঞ্চলে যেখানে পর্যাপ্ত বরফ পড়ত এখন সেখানে বরফপাতের বদলে বৃষ্টিপাত বেশি হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ হিমায়িত অঞ্চ‍‌ল গলে যাচ্ছে। ফলত পাহাড়ের ঢালের ভঙ্গুরতা বাড়ছে, ভূমি ধস বাড়ছে। ২০২২ সালে প্রবল তাপ প্রবাহে হিমাল‍‌য়ের সঞ্চিত বরফের সর্বাধিক হারে গলনের ফলে পাকিস্তানে নজিরবিহীন বন্যা হয়েছিল। ভূ-উষ্ণায়নজনিত গ্লেসিয়ারের সরন ও গলন ২০০০ সালের পর থেকে বেশি হারে বাড়ছে। গ্লেসিয়ার গলে ও সরে গিয়ে গভীর খাদ তৈরি হচ্ছে উৎসস্থলে। সেগুলি বরফ গলা জলে ভরে গিয়ে হ্রদ তৈরি হচ্ছে। এই নবগঠিত হ্রদ বাড়ছে আয়তনে ও সংখ্যায়। এক্সট্রিস ওয়েদার মেঘভাঙা বৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়ায়। তাতে হ্রদগুলির জলস্তর আচমকা অস্বাভাবিক বা‍‌ড়ে। সেই জলই পাহাড়ি নদী ভাসিয়ে প্রবল স্রোতে ধেয়ে আসে নিচে। সিকিমেও সেটাই হয়েছে। আগামীদিনে এমন বিপর্যয়ের ঘটনা বাড়বে। তাই পাহাড়ে নদীর ধারে নতুন বসতিস্থাপন, নির্মাণকাজ, বাঁধ তৈরি ইত্যাদির ক্ষেত্রে কঠোর সতর্কতা প্রয়োজন। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ছাড়া, বিশেষজ্ঞদের মতামত পাহাড়ের কোনও পরিবর্তন, নির্মাণ এখনই নিষিদ্ধ হওয়া জরুরি। নচেৎ এমন ঘটনা দে‍‌খে যাওয়া ছাড়া আর‍‌ কিছু করার থাকবে না।

Comments :0

Login to leave a comment