অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
‘‘রাজনৈতিক কাজ নেভস্কি প্রসপেকটের বাঁধানো ফুটপাত নয়।’’ কথাটা লিখেছিলেন মহান রুশ সাহিত্যিক চের্নিশেভস্কি। নেভস্কি প্রসপেকট ছিল তখনকার পিটার্সবুর্গ শহরের প্রধান মহাসড়ক। ধনী এলাকার ঝা চকচকে রাস্তা। দু’পাশে পাথর দিয়ে বাঁধানো মসৃণ ফুটপাত। চের্নিশেভস্কির কথাটা তখনকার বিপ্লবী মহলে একটা প্রবাদবাক্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। লেনিন নিজে কথাটি বহুবার উল্লেখ করেছেন।
বিপ্লবের পথ যে সোজা সরল প্রশস্ত মসৃণ নয়, চড়াই-উৎরাই, মোড় ঘোরাঘুরি আছে— এ কথাটাই এভাবে বলা হয়।
একই কথা বলেছেন মুজফ্ফর আহ্মদ। তিনি বারে বারে বলেছেন এবং লিখেছেন ‘কমিউনিস্টদের চলার পথ কখনও ফুল বিছানো হয় না।’
বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস তো বটেই আমাদের দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস পড়লেই জানা যায় কত নেতা, কত কর্মী, কত সমর্থক-দরদির বিরাট আত্মত্যাগ ও কষ্ট স্বীকারের মধ্য দিয়ে এ আন্দোলন গড়ে উঠেছে।
তবে এই আন্দোলনের গোড়ার যুগে মুজফ্ফর আহ্মদ ও তাঁদের সহযোদ্ধারা যে প্রবল রাষ্ট্রশক্তির জুলুম ও অত্যাচারকে সহ্য করে কমিউনিস্ট পার্টির ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, তার তুলনা হয় না কোনোভাবেই। সেইসঙ্গে ছিল প্রতিক্রিয়ার আক্রমণ।
লেনিনের থেকে শিক্ষা নিয়ে মুজফ্ফর আহ্মদরা উপলব্ধি করেছিলেন যদি কমিউনিস্ট মতাদর্শের ভিত্তি জোরদার না করা যায়, বিশেষ করে অগণিত কর্মী যদি না জানেন কমিউনিস্ট পার্টি বলতে কী বোঝায়, তাদের লক্ষ্য কী— এবিষয়ে যদি পরিষ্কার ধারণা না থাকে তবে আন্দোলন শুধু দিকভ্রান্ত হবে না, মুখ থুবড়ে পড়বে। কর্মী-সমর্থক-দরদি সকলেই দিশাহারা হয়ে পড়বেন।
এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তাঁরা এদেশে পত্রপত্রিকা, বই প্রকাশনার উদ্যোগ নেন। ১৯৩৯ সালের ২৬ জুন প্রতিষ্ঠা হয় ন্যাশনাল বুক এজেন্সির। সে হিসাবে আজ ন্যাশনাল বুক এজেন্সি ৮৬ বছরে পা দিল।
আর পাঁচটা বইয়ের দোকানের মতো শুধুমাত্র বাণিজ্যিক কারণে ন্যাশনাল বুক এজেন্সির সৃষ্টি হয়নি। অনেক মুনাফা করে সম্পত্তি বাড়ানো তার উদ্দেশ্য ছিল না। এর পিছনে ছিল আদর্শের তাগিদ। অনেকেই ভেবেছিলেন এই প্রকাশনা সংস্থা টিকবে না। আদর্শের ভিত নড়বড়ে হয়ে গেলে এটি উঠে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। আধুনিক পুস্তক প্রকাশনা শিল্প জগতে প্রতিযোগিতার বাজারে মুখ থুবড়ে পড়বে— পড়েনি। আদর্শের তাগিদে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি ৮৬ বছর পেরিয়ে এসেছে।
ন্যাশনাল বুক এজেন্সি আকাশ থেকে পড়েনি। এনবিএ’রও আগে বেশ কিছু ব্যক্তির উদ্যোগে বাংলা ভাষায় মার্কসবাদী বইপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এখানে সে বিস্তৃত আলোচনায় যাচ্ছি না। মুজফ্ফর আহ্মদের নেতৃত্বে কীভাবে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তা অনেকেরই জানা। তবু কাকাবাবুর সেই বিশেষ গদ্যশৈলীতে লেখা উদ্ধৃত না করে থাকতে পারলাম না। তিনি লিখছেন, ‘‘১৯৩৬ সালের ২৬শে জুন তারিখে আমরা দোকান খুলে দিলাম। শুধু বাংলাদেশের নয়, সমস্ত ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম পুস্তকের দোকান। আমাদের মূলধন ছিল: কমিউনিস্ট পার্টির শুভেচ্ছা; কমরেড সুরেন্দ্রনাথ দত্তের শ্রম আর কমরেড রেবতীমোহন বর্মণের জোগাড় করা দুই শত টাকা। দোকানের নাম দেওয়া হলো ন্যাশনাল বুক এজেন্সি।’’
সেইসময় কমিউনিস্ট নেতা কর্মীদের ধরপাকড়, গ্রেপ্তারি যা যা ঘটত, তারা সবগুলির আঁচই এসে পড়েছিল ন্যাশনাল বুক এজেন্সির উপর।
১৯৩৯ সালে সেপ্টেম্বর মাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো। সঙ্গে সঙ্গে হামলা শুরু হলো নেতা কর্মীদের উপর। এনবিএ’র ঐ ছোট্ট দোকানেও দফায় দফায় তল্লাশি হলো। এইসময়কালে মুজফ্ফর আহ্মদ, সুরেন দত্তকে ব্রিটিশ সরকার কলকাতা থেকে বহিষ্কার করল।
এর পরে স্বাধীন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হয়। ১৯৪৯ সালের মে মাসে তৎকালীন ম্যানেজিং ডিরেক্টর সুনীল বসু বিনাবিচারে বন্দি হন।
১৯৬২ সালে এনবিএ’র কর্মীদের ওপর নানা ধরনের হামলা হয়। দু’জন ডিরেক্টর মুজফ্ফর আহ্মদ, আব্দুল হালিম গ্রেপ্তার হন। বিনাবিচারে আটক হন তৎকালীন ম্যানেজিং ডিরেক্টর সুরেন দত্ত। আবার আটক হন সুনীল বসু।
ন্যাশনালের প্রয়াত কর্মী রবীন ঘোষের স্মৃতিচারণায় আছে কীভাবে ১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে ২ নম্বর সূর্য সেন স্ট্রিটে বইয়ের গুদামে গুন্ডারা আগুন লাগিয়ে দেয় এবং জ্যোতি বসুর কুশপুতুল পোড়ায়। এরফলে প্রচুর বইয়ের ক্ষতি হয়েছিল।
শুধু তো আক্রমণ নয়, যেসব কর্মীরা আক্রান্ত হননি বা জেলে যাননি তাঁদের কষ্টস্বীকারের কথাও স্বীকার করতে হয়। যৎসামান্য অর্থের বিনিময়ে কোনোমতে সংসার চালিয়ে তাঁরা যেভাবে দশকের পর দশক ধরে এনবিএ’র মতো প্রতিষ্ঠানকে বুকে আগলে রেখেছেন তার ইতিহাস কি কোনোদিন লেখা হবে?
আজকের দিনেও ন্যাশনাল বুক এজেন্সিকে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। প্রতিকূলতার চরিত্র বদল ঘটেছে অনেকটা। কাকাবাবুদের সময় আর আজকের দিনগুলি মোটেই একরকম নয়।
সব থেকে বড় কথা সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা পূর্ব ইওরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের পর মার্কসবাদের যথার্থতা, প্রাসঙ্গিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দেওয়া হলো গোটা দুনিয়ার সামনে। তাকে প্রতিরোধ করা কোনও সহজ কাজ ছিল না। এনবিএ’র কথাই ধরা যাক। এনবিএ সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত বিপুল পরিমাণ মার্কসবাদী ও অন্যান্য প্রগতিশীল বই বিক্রি করত। বই আসত চীন থেকেও, ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় লেখা। আসত লন্ডন থেকে লরেন্স অ্যান্ড উইশার্ট সংস্থার বেশ কিছু ভালো ভালো মার্কসবাদী বইপত্র। এসবই বন্ধ হয়ে গেল নতুন পরিস্থিতিতে। এরসঙ্গে যুক্ত হলো নয়া উদার আর্থিক নীতি, যা আমাদের সমাজজীবনে বেশ কিছু পরিবর্তন আনল। ভোগসর্বস্বতার স্রোতে মানুষের মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটল। পাশাপাশি এল আধুনিক বৈদ্যুতিন প্রযুক্তি। আজ আমরা এমন এক অবস্থায় বাস করছি যেখানে মোবাইল নির্ভরতা প্রচণ্ডরকম বৃদ্ধি পেয়েছে। এসে গিয়েছে ই-বুকের বিকল্প। জোরদার হয়েছে সোশাল মিডিয়া। বিরাট পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স।
এই চ্যালেঞ্জের মুখে লড়াই করতে হচ্ছে আজকের ন্যাশনাল বুক এজেন্সিকে। পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী ন্যাশনালের কাঠামোগত আধুনিকীকরণের কাজ অনেকটাই সম্পন্ন হয়েছে। নিজস্ব অনলাইনে বই বিক্রি পরিষেবা চালু হয়েছে। ভারতের যে কোনও প্রান্ত অনলাইনে ঘরে বসে এনবিএ’র বই এখন পাওয়া যায়। সংস্থার নিজস্ব কাউন্টারগুলি কিছুটা সুসজ্জিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিগত বছরে ন্যাশনাল থেকে প্রকাশিত নতুন বই ও পুনর্মুদ্রণের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির যা চাহিদা, তার থেকে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে আছি।
জানি অনেকে বলবেন, বই পড়ার অভ্যাসই কমে যাচ্ছে। সারাক্ষণ মোবাইলে মুখ গুঁজে কোথা দিয়ে যে সময় চলে যাচ্ছে কে জানে?
বইপড়া সত্যিই কমছে কিনা, কমলে কতটা কমছে, শেষপর্যন্ত বইয়ের বিকল্প কি আদৌ কিছু তৈরি হলো এনিয়ে আলোচনা করতে চাইছি না এখন। কিন্তু প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে একথা জোরের সঙ্গে বলতে পারি ভালো বইয়ের এখনও বিক্রি আছে। প্রবীণ-নবীন নির্বিশেষে সকলেই ভালো বই পেলে কেনেন ও পড়েন। আজকের তরুণ প্রজন্ম বই পড়ে না গোছের আলগা মন্তব্যে গা ভাসাতে রাজি নই।
প্রশ্নটা হলো, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি কি চাহিদা মেটাতে পারছে? না সে দাবি আমরা করতে পারি না। বিশেষ করে আজকের দিনে চিরায়ত মার্কসবাদী বইপত্রের আরও বেশি প্রকাশ জরুরি। মার্কস ও এঙ্গেলসের যে বিপুলায়তন রচনা সমগ্র ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হচ্ছে (যত দূর জানি ইতিমধ্যেই ৬০ খণ্ড হয়েছে এবং তা শতাধিক খণ্ডে গিয়ে শেষ হবে) তার যৎসামান্যও বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়নি। আবার অনুবাদ করলেই হলো না, তা যথাযথ ও সুখপাঠ্য হওয়া প্রয়োজন। সঙ্গে থাকা দরকার ব্যাখ্যামূলক ভূমিকা ও পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা সহ টীকা। শুধু মার্কস এঙ্গেলসের লেখা নয়, আজকের বিশ্ব পরিস্থিতিতে দুনিয়াজুড়ে অজস্র মার্কসবাদী পণ্ডিত মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতা জোরের সঙ্গে উপস্থিত করছেন। প্রতিবেশী দেশ চীনও চর্চার বিষয়ে অনেক এগিয়ে গিয়েছে, যার কিছু কিছু তারা ইংরেজি ভাষায় বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থিত করছে। এনবিএ কি পারবে এইসব বিষয় বাংলা ভাষায় সাধারণ পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে? অবশ্যই সেসব বইয়ের দাম নাগালের মধ্যে থাকতে হবে।’ অনুবাদের পাশাপাশি বাংলা ভাষায় মার্কসবাদ বিষয়ক মৌলিক বই প্রকাশ করতে পারলে তো আরও ভালো।
সেইসঙ্গে ইতিহাস, দর্শন, রাজনৈতিক অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয়ের বই, গল্প-উপন্যাস প্রভৃতি সৃষ্টিশীল সাহিত্যের বই, শিশু কিশোর সাহিত্যের প্রয়োজন আছেই। এনবিএ সেগুলি সাধ্যমত প্রকাশ করে থাকে। আবার এনবিএ’র একার পক্ষে সব ধরনের বইপ্রকাশ সম্ভব নয়, তাই অন্যান্য প্রকাশনার প্রগতিশীল ভালো বই বিক্রির ব্যবস্থা আছে। রাজনৈতিক দায় থেকেই এনবিএ এই কাজ করে থাকে।
আমরা সকলেই লক্ষ্য করেছি, বিশেষ করে যখন ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে কোনও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় তখন দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষজন বই কেনার জন্য স্টলের সামনে একেবারে হামলে পড়েন। অল্প সময়ের মধ্যে এত বই বিক্রি হয় যে এনবিএ’র কর্মীরা দিয়ে উঠতে পারেন না। স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্য নিতে হয়। বই বিক্রির ধরন দেখে, ক্রেতাদের আগ্রহ দেখে অনুমান করা যায় এইসব অংশের মানুষের কাছে কোনোভাবেই এনবিএ’র বই সারা বছর পৌঁছায় না। তাই ব্রিগেডে এসে তাঁরা যতটা সম্ভব বই কেনেন।
একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই পশ্চিমবঙ্গের বহু জেলায় মার্কসবাদী, প্রগতিশীল বইয়ের স্থায়ী দোকান নেই। বহু জেলার বিস্তীর্ণ প্রান্ত আছে যেখানে হয়ত শারদোৎসবের সময় কিছু বই বিক্রি হয়। বাকি সময় কিছুমাত্র হয় না। অর্থাৎ বই বিপণনে ভালোরকম দুর্বলতা আছে।
এই দুর্বলতা কাটিয়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। জেলায় জেলায় কী করে বই বিক্রি বাড়ানো যায় তার জন্য ভাবনাচিন্তা ও উদ্যোগ শুধু হয়েছে। আগামী ২২ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট ন্যাশনাল বুক এজেন্সির কলকাতা, বিধাননগর ও দুর্গাপুরের নিজস্ব কাউন্টার থেকে বড় রকমের ডিসকাউন্ট দিয়ে বই বিক্রির ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
লড়াই সংগ্রামে চলার পথের দীর্ঘমেয়াদি পাথেয় যোগানের দায়িত্ব ন্যাশনাল বুক এজেন্সির। সেই পাথেয় মতাদর্শ। তাই এনবিএ যত শক্তিশালী হবে লড়াই আন্দোলন তত প্রসারিত ও দীর্ঘস্থায়ী হবে। আবার আন্দোলন শক্তিশালী হলে ন্যাশনাল বুক এজেন্সির শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে। তাই এই বহু ঐতিহ্যবাহী গর্বের এনবিএ-কে সযত্নে লালন করা ও তার আরও উন্নতি ঘটানো আমাদের সকলের কর্তব্য।
লেনিনের থেকে শিক্ষা নিয়ে মুজফ্ফর আহ্মদরা উপলব্ধি করেছিলেন যদি কমিউনিস্ট মতাদর্শের ভিত্তি জোরদার না করা যায়, অগণিত কর্মী যদি না জানেন কমিউনিস্ট পার্টি বলতে কী বোঝায়, তাদের লক্ষ্য কী তবে আন্দোলন শুধু দিকভ্রান্ত হবে না, মুখ থুবড়ে পড়বে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তাঁরা এদেশে পত্রপত্রিকা, বই প্রকাশনার উদ্যোগ নেন। ১৯৩৯ সালের ২৬ জুন প্রতিষ্ঠা হয় ন্যাশনাল বুক এজেন্সির।
Post Editorial
আদর্শের তাগিদে এনবিএ’র ৮৬ বছর

×
Comments :0