মাত্র কয়েকদিন আগের ঘটনা, ঊৎসবের সবে মাত্র শুরু, গোটা কলকাতা জলমগ্ন, স্রেফ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রাণ গেল এগারো জন নাগরিকের। মহানগরের চারিদিক যখন বিপর্যস্ত, তখন রাজ্য প্রশাসন নির্বিকার, কলকাতা কর্পোরেশনের কোনও হেলদোল নেই, পানীয় জলের হাহাকার, বহু এলাকায় রাস্তা ছাপিয়ে ঘরের মধ্যে একহাঁটু জল। সেই আধাঁর সকালে সমাজমাধ্যমে উপহার এল মুখ্যমন্ত্রীর পুজোর গান।
আরও ভয়াবহ পুনারাবৃত্তি দেখলো রাজ্য। যখন উত্তরবঙ্গে বন্যা ও ধসের কারণে মৃত্যু মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম, তখন কলকাতার রেড রোডে আলোর বন্যায়, পারিষদ সহযোগে রুপালি পর্দার সেলিব্রিটি, তাঁর সরকারের হোমরাচোমড়াদের নিয়ে তিনি, সেই বিখ্যাত তিনি প্রতিমা বিসর্জনের কার্লিভানে মেতেছেন। এই শহরে উৎসবের ফোয়ারা। সেখানে গান আছে, নাচ আছে। হুল্লোড়ের সেই মহাসমারোহে তারকাদের সাথে ঢাকের তালে নাচেও আছেন সেই মুখ্যমন্ত্রী। উত্তর ভাসছে আর মমতা হাসছেন।
এই করুণ ছবিই এখন এই বাংলার প্রকৃত চালচিত্র। একে অপরাধের কোন ধারায় ফেলবেন এরাজ্যের ভুক্তভোগী নাগরিকবৃন্দ?
এরমধ্যেই অবশ্য সমাজমাধ্যম মারফত মুখ্যমন্ত্রীর অমোঘ বাণী পেলেন রাজ্যবাসী, তিনি আগামীকাল উত্তরবঙ্গ সফরে যাবেন প্রশাসনের মাথাদের সঙ্গে নিয়ে! আপাতত উত্তরবঙ্গ অপেক্ষা করুক তাঁর উৎসবের কার্নিভাল শেষ হওয়া পর্যন্ত।
গোটা উত্তরবঙ্গ বিপর্যস্ত। রাজ্যের একটা অংশের মানুষ নিজেদের ঘর বাড়ি হারিয়ে অসহায়। মৃত্যুর তালিকা প্রতি ঘণ্টায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। গতকাল রাতের বৃষ্টিতে ভয়ঙ্কর বিপদের প্রহর গুনছে উত্তরের জনজীবন। একাধিক এলাকা ভেসে গিয়েছে। বন্যা কবলিত উত্তরবঙ্গের প্রায় সব জেলা। বহু বাড়ি ভেসে গিয়েছে। বহু রাস্তায় ধস নেমেছে। দার্জিলিঙ শিলিগুড়ির মধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে যোগাযোগ। টানা বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত উত্তরবঙ্গের সাথে সিকিমও। আটকে পড়ে রাস্তায় পর্যটকরা। হন্যে হয়ে এখানে ওখানে ছুটছেন, একটু আশ্রয়ের জন্য। একটানা মুষলধারে বৃষ্টিতে ধস নেমেছে একাধিক পাহাড়ি এলাকায়। শুধুমাত্র মিরিক এবং সুখিয়ায় ধসে চাপা পড়ে এক শিশু সহ তেরো জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। বিপর্যয় মোকাবিলা সেনাবাহিনীর একাধিক দল উদ্ধার কার্য চালাচ্ছে। গোটা পাহাড়-তরাইয়ের জনপদে মৃত্যুর সংখ্যা ২৩ ছাড়িছে। এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছে প্রশাসন। শুধু মানুষের জীবনই নয়, বিপন্ন অবস্থায় বনাঞ্চলের বন্যপ্রাণীরাও। জঙ্গল এলাকার বিভিন্ন নদীতে প্রবল জলচ্ছ্বাসে বহু প্রাণী জলবন্দি হয়ে পড়েছে, জলের তীব্র স্রোতে ভেসেও গিয়েছে অনেক। উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ জঙ্গল ও সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এই বন্যা পরিস্থিতি এখন বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উত্তরবঙ্গের পরস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে অবিলম্বে প্রাকৃতিক বিপর্যয়’ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে সিপিআই(এম)। দাবি জানিয়েছে, এই ক্ষয়ক্ষতির এবং পরিস্থিতি মোকাবিলার দায়িত্ব নিতে হবে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারকে। শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর এক্স হ্যান্ডেলে সহানুভূতির বিবৃতি যথেষ্ট নয়। ইতোমধ্যেই রাজ্য প্রশাসনের কার্যকর উপস্থিতির অভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন বিপর্যস্ত এলাকাবাসীরাই, তাঁরাই একে অপরের দিকে সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছেন। সিপিআই(এম) কর্মীরা এবং রেড ভলান্টিয়াররাও নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী বন্যা কবলিত মানুষদের পাশে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এই ঘটনাকে ‘ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়’ ঘোষণা করার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পুনর্বাসন সহ উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে। এখন দ্রুততার সাথে উদ্ধারকার্যের দাবিও জানিয়েছে সিপিআই(এম)।
এই ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের সময় মুখ্যমন্ত্রী কি তাঁর প্রশাসনিক দায় সামলাবেন, নাকি অন্য রাজ্যের জল, অন্য রাজ্যের বৃষ্টির প্রলাপ ভাষণ দেবেন। যে ভাষণ বরাবর শুনে আসছেন রাজ্যবাসী। এই প্রলাপের কোনও ক্ষমা হয় না।
Editorial
কোনও ক্ষমা হয় না

×
Comments :0