মণ্ডা মিঠাই
গরম গরম
তুষার বসু
নতুনপাতা
বিগত কয়েকটা দিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং মানুষের কথা-বার্তায় একটা কথা উঠে আসছে যে
“ও: কী গরম পড়েছে! আর সহ্য করা যাচ্ছেনা। “
কিন্তু গ্রীষ্মে গরম পড়বে, বর্ষায় বৃষ্টি আর শীতকালে ঠান্ডা, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। চারপাশ থেকে ‘'গরম পড়েছে, গরম পড়েছে ‘’ বলে একটা হাইপ তুলে দেওয়া হচ্ছে। আর সেই কলরোলের ঠ্যালায় দেদার বিকিয়ে যাচ্ছে এসি, কুলার কিংবা ইলেক্ট্রিক পাখা সঙ্গে পেপসি , কোক, স্প্রাইট, আইসক্রিম, কোল্ড কফি ইত্যাদি ইত্যাদি। কে জানে হয়তো এই হাইপ ছড়ানোর পিছনে সূক্ষ্মভাবে কোনও বাজারী মস্তিষ্কের অবদান রয়েছে!!
আমাদের ছোটবেলায়, ৬০-৭০ এর দশকে কি গরম পড়তো না? বৈশাখের রাত্রে কি আমরা কম্বল চাপা দিয়ে ঘুমোতাম? তা নয়, তখনও গরম অনুভূত হতো। বৈশাখ মাস পড়লেই সকাল স্কুল চালু হয়ে যেত। আমাদের পুরোহিত ভৃগুরাম পাঠক বেলা দেড়টা থেকে আড়াইটের মধ্যে মাথায় একটা ভিজে গামছা চারপাট করে চাপিয়ে খড়ম খটখটিয়ে ছাদের চিলেকোঠার ঠাকুরঘরে নিত্যপুজো করতে হাজির হতেন। গরম পড়েছে বলে কোনোদিন তার আগে এসেছেন বলে দেখিনি। বয়স্করা দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর একটা ভিজে গামছা গায়ে জড়িয়ে হাতে তালপাতার পাখা নিয়ে আমাদের বাঁধানো ঘাটের আমগাছের নিচে আড্ডা দিতেন। পুকুরের উপরের জল গরম হয়ে যেত। নিচের দিকে পাঁক সংলগ্ন জল থাকতো ঠান্ডা। হাতের টানে সেই নিচের জলকে উপরে তুলে ঘন্টার পর ঘন্টা জলে পড়ে থাকতাম। হাতের আঙুলগুলো চুপসে যেতো, গায়ের রঙ হয়ে যেত সাদাটে। বাবার বকুনিতে যখন উঠে আসতাম মালুমই হতোনা গরম পড়েছে বলে। রাত্রে শুয়ে থাকতাম ছাদে মাদুর পেতে। মাঝরাতে ঝড় উঠলে কিংবা বৃষ্টি এলে তড়বড়িয়ে নেমে আসতাম ছাদ থেকে। মাদুর উড়ে যেত পাশের বাড়ির ছাদে। এছাদ ওছাদ গল্প করতে করতে চাঁদকে দেখতাম পশ্চিমদিকে ঢলে পড়তে।
আশ্চর্যজনকভাবে প্রত্যেক বাড়িতেই এমন দুএকজনকে পাওয়া যেতোই যারা জোরগলায় দাবি করতেন যে ঘুমিয়ে পড়লেও তাঁদের হাতের পাখা চলতে থাকে। সেই কথায় ভুলে মারামারি ঠেলাঠেলি করে তাঁর পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম আর হঠাৎই ঘুমের মধ্যে নাকে -মুখে-মাথায় খটাং করে এসে পড়ত সেই চিরচলনশীল হাতের পাখাটি। আবার তাঁকে ঠেলেঠুলে জাগিয়ে দিয়ে হাতে পাখাটি ধরিয়ে দিতাম। বলা বাহুল্য যে তারপরেও সেই পাখা ঘুমঘোরে অবশ্যম্ভাবী বিপদের মতোই নেমে আসত মাথার উপর। ঘুমে-জাগরণে রাত কেটে যেত।
আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ হয়েছে ৭১-৭২ কি তারও পরে। কিন্তু কটা বাড়িতেই বা বিদ্যুৎ ছিলো। পাখা ছিলো আরও কম বাড়িতে। সারাদিন দুতিন ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকলে অনেকক্ষণ আছে মনে করা হতো। এমনই ছিলো লোডশেডিংএর দাপট। তার ওপর ছিলো লো ভোল্টেজ নামে একটি ক্রনিক অসুখ। তার দৌলতে সন্ধ্যের পর পাখা চলা তো দূরস্থান ৬০ ওয়াটের বালবের ফিলামেন্টটা জ্বলছে কিনা বোঝার জন্যে হ্যারিকেনের আলোর প্রয়োজন হতো।
দুপুরবেলায় শোবার জন্যে থাকতো বেতের ছাল দিয়ে তৈরি শীতলপাটি।সকালে পুকুরে ডুবিয়ে রেখে আসতাম তারপর সেটিকে তুলে এনে জল ঝরিয়ে পেতে দিতাম মেঝের ওপর। পিঠের নিচে সেই সুশীতল পাটির স্পর্শে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়তাম।
ব্যাংক বা সরকারি অফিসে এসির বদলে জানলায় জানলায় ঝোলানো থাকতো ঘাসের শিকড়ের তৈরি খসখস। ঘন্টায় ঘন্টায় পিতলের পিচকারিতে জল ভরে সেই খসখস ভিজিয়ে দেওয়া হতো। তার মধ্যে দিয়ে ঠান্ডাবাতাস আসতো। মাটির কলসীতে ভিজে লালশালু জড়িয়ে রাখা হতো খাওয়ার জল।
গ্রীষ্মের দুপুরে ট্রলিভ্যানে চাপিয়ে কাঠের গুঁড়ো ঢাকা বরফ নিয়ে আসতো এক বিহারী ফেরিওয়ালা।
উল্টো করে রাখা পেল্লায় এক র্যাঁদার উপর বরফের চাঙড় ঘষে ঘষে শালপাতায় তৈরি করতো ঝুরো বরফ। লাল-হলুদ-সবুজ সিরাপ মেশানো সেই অমৃতের স্বাদ গরমকে রমণীয় করে তুলতো।
আসলে আমরা তখন এত ফ্যানাসক্ত (fan +আসক্ত) বা এসিবিলাসী হয়ে উঠিনি। আমাদের ছিলোনা পাঁচ-দশ ইঞ্চির ইঁটের দেওয়ালের ওপর চাপানো চার ইঞ্চির কংক্রিটের ছাদ। বেশির ভাগ মাটির বাড়ি, খড়ের চাল। টিন বা টালির ছাউনি থাকলে অবশ্যই তার নিচে থাকতো মাঠকোঠা নামের মাটির আস্তরণ। যে কয়েকটি হাতে গোনা পাকাবাড়ি ছিলো তাদের দেওয়াল ছিলো কমপক্ষে পনেরো ইঞ্চি বা আমাদের বাড়ির মতো পঁচিশ/তিরিশ ইঞ্চি। উপরে চুন-সুরকির পেটাই ছাদ। সুর্যের সাধ্য ছিলোনা সেই সব দুর্ভেদ্য দুর্গের মধ্যে গরমের অনুপ্রবেশ ঘটানোর।
আজ আমাদের সহনশীলতা কমে গেছে। একটুতেই অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি। গরম পড়তেই ত্রাহি ত্রাহি রব তুলে দিচ্ছি। নাহলে ১৯৮০ সালে যে গরমটা পড়েছিলো (৪১.৭°) সেই রেকর্ড এখনও অম্লান থাকা সত্ত্বেও আমরা এমন ‘’গেলুম, গেলুম’ করি!!!!
Comments :0