মুক্তধারা | গল্প
রসুনের বর
ময়ূরী মিত্র
পর্ব -২
রাত আটটা ৷ হেমন্তের আকাশে হাতীরঙ মেঘ ৷ সন্ধেতে যদিও মেঘকে আর আলাদা করে দেখা যাচ্ছে না ৷ গোটা আকাশটাই মত্ত হাতী ৷ সন্ধে থেকে মোটা মাঝারি সরু নানারকম বৃষ্টি হয়েছে ৷ রাত আটটা নাগাদ রিহার্সাল শেষ করে বাগুইহাটি দাঁড়িয়ে ভিজছি ৷
-- ছাতা নেন নি কেন ? একদম রসুনের মতো স্বভাব আপনার !
--বলেই শামুক হয়ে গেল দিলু। বোধহয় কথার এলাকা টপকে গেছে বলে ৷
বললাম -দিলু ৷ আজ আর বোলো না স্ট্যান্ডের রিক্সা নিন ৷ আমি অন্য এলাকার ৷ দেখছ তো -স্ট্যান্ডে রিক্সা নেই ৷
চোখ পিটপিট করল দিলু ৷ ভালো করে স্ট্যান্ড খুঁজল ৷ রিক্সাওয়ালা সওয়ারী পেলে অন্য রিক্সাওয়ালাকে পাশ কাটিয়ে যায় ৷ দিলু ব্যাটা এলাকার বাইরে হলেই সেই এলাকার স্ট্যান্ডের রিক্সাওয়ালা খোঁজে ৷ আমার এথিক্যাল বন্ধু ৷
আঙুল ধরে রিক্সায় তুলল দিলু ৷ খানিক গিয়ে একটা পুকুরপাড়ে ঝুপ করে নেমে পড়ল ৷ দেখি ,পুকুর ধারের ঘাসের মধ্যে একটা মোটর রিক্সা মুখ থুবড়ে পড়ে ৷ রিক্সাটার সবটা ঝকঝকে ৷ কেবল চাকা মাটিতে বসে ৷দিলু দেখি , ছেলেমানুষের মতো একবার রিক্সায় উঠছে আর মাটিতে ঝাঁপাচ্ছে ৷ গায়ে বৃষ্টির জল চিকচিক করছে ৷ বিকট চেঁচাচ্ছে
দিলু --
বৌদি , এই দেখুন কায়দা করে ব্যাঙ্ক থেকে এক লক্ষ পঁচিশ হাজার লোন করে মোটররিক্সা কিনেছে ! তারপর চালাতে না পেরে ঘাসে রিক্সা পুঁতে পালিয়েছে ৷ শালা চালাস রিক্সা ! রিক্সার গতিতে রিক্সা চালা ! তা না লোকের টাকা নিয়ে মোটর চালাবে ৷ নে শালা নে -এবার তোর ত্যাজ্যপুত্তুরের গা বেয়ে বটগাছ উঠবে ৷ ছায়া খাবি আর লোনের টাকা কী করে শুধবি ভাববি ৷
এক অজানা মানুষের পরিত্যক্ত রিক্সার চারপাশে পায়রার মতো ঘুরে ঘুরে যুক্তিহীন গল্পের দানা খাচ্ছিল ৷ আমার ভেতর কঠিন না দ্রব হচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম না ৷
---দিলু রিক্সায় ওঠ ৷ আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে ৷ জান তো তোমার এলাকা এখান থেকে কত দূর ! আর সেই এলাকায়ই আমার বাড়ি সেটাও জান ! এবার চল ৷ অন্য লোকের জিনিসে হাত দিতে নেই তুমি জান না ?
--দিলু ভাবলেশহীন ৷
--ও তো অন্য লোকের টাকা লোন করে কেনা রিক্সা ৷ মালিক বলে ও রিক্সার কেউ নেই ৷
বকে উঠলাম --
ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে কেনা ৷ লোকের টাকা বলছ কেন ?
দিলু ডবল চেঁচাল -বিশ্রীভাবে ঝগড়া করতে লাগল আমার সঙ্গে --
একদম আজেবাজে কথা বলবেন না বৌদি ৷ অনেক ক্ষণ ধরে আপনি আমার কোনো কথায় হ্যাঁ বলছেন না ৷ আমি রেগে যাচ্ছি এত -তাও বলছেন না -দিলু তুমি রাইট ৷ বলি -ব্যাঙ্কে লোকেরই তো টাকা থাকে নাকি ? কী ভুল বলেছি আমি ! এসে গেছি ৷ যান নিজে নামুন ৷ আমি আঙুল ধরতে পারব না ৷ যান -সবার মতো নামুন স্মার্টলি ৷
টাকা মিটিয়ে একটাও কথা না বলে চলে আসছি ৷ হঠাৎ পিছন থেকে --
--বৌদি
--বাড়ি যাও দিলু ৷ আর কোনো কথা বলব না তোমার সঙ্গে ৷
দিলু শুনছে না ৷ রিকশায় প্যাঁকপ্যাঁক আওয়াজ করতে করতে আমার প্রত্যাখ্যান পাত্তাই দিচ্ছে না দিলুকুমার ৷ কব্জিটা চেপে ধরে সে শুধু বলল --
বৌদি দুপুরবেলা বাড়ি না ফিরে যদি রিক্সা চালাই , তারপর ধরুন ভোর সাতটার জায়গায় যদি ছটায় রিক্সা বার করি - তাহলে কদিনে একটা মোটর রিক্সা কিনতে পারব ? বলুন না ৷ আসলে রসুনটা এত ঘুমকাতুরে সকালে উঠে যে এট্টু রুটি করে দেবে বেশী করে --- ! তবে বৌদি মোটররিক্সা যদি একবার কষ্ট করে কিনতে পারি তো রসুনকে চড়িয়ে একটা সেলফি তুলবই ৷ রসুন গ্রামে পাঠাবে ৷ বিহারী শালারা ভড়কে ছানা !
কী সব ভাষা বলছে দিলু !
-- এই দিলু ৷ ওকি বিহারীদের শালা বলছ কেন ! একী অসভ্য লোক তুমি ! জাত তুলে কথা !
হ্যা হ্যা করে হাসতে হাসতে বলল --বৌদি বিহারীদের শালা বলিনি ৷ বলেছি বিহারী শালারা ---আরে বৌদি রসুনের ভাইগুলোকে বলেছি ---শালাই ত ওরা আমার !
এই এতক্ষণ ঝগড়া করল ৷ আবার এখন রগড়
করতে লেগেছে ৷ দিলুটা আজ মাথা খারাপ করে দিচ্ছে আমার !
বাড়ি ফিরে সদ্য কেনা উজ্জ্বল বাতির আলোয় দেখেছিলাম আমার কব্জিতে দিলুর আঙুলের পাঁচটা ময়লা দাগ ৷ আমার পথের সাথীর গায়ের ধুলো বৃষ্টিতে ভিজে ঘোর কালো হয়েছিল ৷
সমাপ্ত
Comments :0