গল্প
মুক্তধারা
ছায়ার প্রিমিয়ার
অয়ন মুখোপাধ্যায়
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, বর্ষ ৩
সন্ধ্যা হবো হবো । বাগুইআটির হিন্দু বিদ্যাপীঠের এক কোণে একটা মোমবাতি জ্বলছে। স্কুলের ঘরে রাখা পুরনো বেঞ্চে বসে অজিত চোখ মুছে নিলেন। সেদিনই তিনি প্রথম শুনেছেন— নতুন নাটকের জন্য দল ভাঙবে। কতদিনের আপনজন, কত হাসি-কান্না, কত অনুশীলন! তবু কি এরপরেও ভাঙন ধরতে পারে?
ক্লাসরুমের জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল ঝাপসা আলো। বাইরে পাড়ার মাঠে কয়েকজন ছেলে এখনও ফুটবল খেলছে। অজিত তাদের দেখে যেন নিজের ছোটবেলার দিনগুলোর কথা মনে করলেন। যুদ্ধের ভয়, পালিয়ে যাওয়া, তারপর থিয়েটারের প্রথম মঞ্চ। তখন তো কিছুই ছিল না— শুধু এক গলা ডায়লগ, এক অচেনা আলোয় দাঁড়িয়ে থাকার আনন্দ।
“অভিনয় মানে শুধু মঞ্চ নয়, অজিত।” গুরু প্রবোধবিকাশ চৌধুরীর কথা মনে পড়ে গেল।
“অভিনয় মানে মানুষের ভেতরটা খুলে ফেলা।”
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মানুষ কে কি তিনি সত্যিই খুলে দেখাতে পেরেছেন? নাকি শুধু চরিত্রের ভেতর ঢুকে থেকে বেরোতে ভুলে গেছেন?
পরদিন রিহার্সাল। নাটকের নাম নানা রঙের দিন। কিন্তু কারও চোখেই যেন রঙ নেই। মুখগুলো ক্লান্ত, সন্দেহে ভরা। দলে ফাটল ধরেছে। কিছু অভিনেতা চান নতুন দিকনির্দেশনা, কিছু কিছু অভিনেতা নাট্যকর্মী আবার পুরনো রাস্তায় আঁকড়ে থাকতে চায়। অজিত চুপচাপ সবাইকে দেখতে থাকেন। হঠাৎ মনে হলো, এ শুধু নাটকের ফাটল নয়— জীবনেরও।
এক রাতে বাড়ি ফেরার সময় তিনি দেখলেন রেলস্টেশনের অন্ধকারে কিছু ছেলে গান গাইছে। গানের সুর খুব সাধারণ, কিন্তু তাতে অদ্ভুত টান। সেই টানেই যেন তিনি বুঝলেন, তাঁর পথটা কেমন হবে। নতুন দল, নতুন নাম, নতুন স্বপ্ন। নান্দীমুখ— শব্দটা তখনও মাথায় আসেনি, কিন্তু মনে হচ্ছিল কোথাও একটা নতুন দরজা খোলা হচ্ছে।
স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি কি সব ছেড়ে দিতে চাইছো?”
অজিত বললেন,
“সব নয়, কিছু রাখব। শুধু ছায়া ফেলে আলোটা নিয়ে যাব।”
কয়েক মাস পরেই নতুন দল তৈরি হলো। প্রথম শো-তে ভিড় হয়নি। অনেকে বলল, “এরা পারবে না।” কিন্তু যখন মঞ্চে আলো পড়ল আর সংলাপ শুরু হলো— মানুষ হেসে উঠল, কাঁদল, হাততালি দিল। সেদিন অজিত বুঝলেন, নাটক ভেঙে যায় না। দল ভাঙে, সম্পর্ক ভাঙে, কিন্তু নাটক? সে তো নদীর মতো— এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটে চলে যায়।
তবু ভিতরে ভিতরে অজিত জানতেন, সময় তার বিরুদ্ধে কাজ করছে। শরীর ক্লান্ত, জীবন অনিশ্চিত। তবু তিনি মঞ্চ ছাড়লেন না। মঞ্চই তো ছিল তাঁর আসল বাড়ি।
শেষ জীবনে এক বন্ধুকে তিনি বলেছিলেন,
“আমার নাম মনে রাখার দরকার নেই। শুধু মনে রাখুক— আমি অভিনয় করেছি। মানুষের কষ্ট, মানুষের আনন্দ, মানুষের রঙ— সব নিয়ে একটা মঞ্চ বানিয়েছিলাম।”
সেই রাতে, পুজোর কোলাহলে ঢেকে যাচ্ছিল শহর। দূরে কোথাও শাঁখ বাজছে, ঢাকের তালে মানুষ নাচ্ছে। অজিতেশের চোখে ঘুম নেই। তাঁর চোখ আধখোলা, যেন মঞ্চের দিকে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ মনে হলো, জানলার ওপাশে নীল রঙের ডিমারের আলো ভেসে আসছে । মঞ্চের স্মোকের ধোঁয়া আস্তে আস্তে আকার নিচ্ছে— সামনে বিশাল একটা নাটকের সেট , আলো জ্বলছে, চরিত্রেরা একে একে প্রবেশ করছে।
আজ অজিতেশ সমস্ত চরিত্রগুলোকে চিনতে পারছে কষ্টভরা কৃষক, হাসিখুশি কিশোর, হারানো দিনের কমরেড বিদ্রোহী যুবক, ক্লান্ত বৃদ্ধ । তারা সবাই তাঁর লেখা
সংলাপ বলছে, আর অজিতেশ মৃদু হাসছেন। যেন জীবনের সব নাটক এসে জড়ো হয়েছে ওই ছোট্ট ঘরে।
ঠিক তখনই বাইরে ঢাকের শব্দ আরও তীব্র হলো। যেন দেবী নিজেই মঞ্চে পা রাখলেন। অজিতেশের বুকের ভেতর আলোর ঢেউ উঠল। মনে হলো, নতুন কোনো দরজা খুলে যাচ্ছে না— বরং নতুন কোনো প্রিমিয়ারের আলো জ্বলছে।
সেদিনই দুর্গাপুজো। শহরে আনন্দ, ভিড়, ঢাক-আলোর মেলা। আর এক কোণে, নিঃসঙ্গতার পাহাড় চূড়ায় বসে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় শান্তভাবে মঞ্চের ভেতর ঢুকে পড়লেন। কেউ জানল না, তিনি চলে গেলেন নাকি অভিনয় শুরু করলেন নতুন করে।
শাঁখ বাজছে, ঢাক বাজছে, আর ছায়ার প্রিমিয়ার-এ আলো নেভে না।
Comments :0