STORY / AYAN MUKHOPADHAYA / HRIDAYAR PUJO / MUKTADHARA / 12 OCTOBER 2025 / 3rd YEAR

উৎসবে অনুভবে / গল্প / অয়ন মুখোপাধ্যায় / অলীক উপস্থিতি / মুক্তধারা / ১২ অক্টোবর ২০২৫, বর্ষ ৩

সাহিত্যের পাতা

STORY  AYAN MUKHOPADHAYA  HRIDAYAR PUJO  MUKTADHARA  12 OCTOBER 2025  3rd YEAR

মুক্তধারা

গল্প

 

অলীক উপস্থিতি

-----------------------------

অয়ন মুখোপাধ্যায়

-----------------------------

 

২ অক্টোবর ২০২৫, বর্ষ ৩
 

 

বড় বড় লাইট ঝুলছে মণ্ডপের বাইরে। যেন একেকটা নক্ষত্র টেনে এনে বাঁধা হয়েছে শহরের গলির মাথায়। মণ্ডপের সামনে বিশাল পোস্টার—স্থানীয় মন্ত্রীর গাঢ় হাসি। আশ্চর্যের ব্যাপার, প্রতিমার মুখের দীপ্তির চেয়েও পোস্টারের দাঁত-চকচকে হাসিই বেশি চোখে লাগে।

ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক। নাম ঋজু মুখোপাধ্যায়। বয়স মাত্র তিরিশের কাছাকাছি, চোখের তলায় ক্লান্তির ছাপ, জামায় লেগে আছে রঙের দাগ। মণ্ডপের ভেতরের প্রতিটা ছবি—সিংহের অগ্নিগর্ভ চোখ, দুর্গার পিছনে মেঘাচ্ছন্ন পাহাড়, গ্রামীণ জীবনের টানটান রেখাচিত্র, এমনকি এক দেওয়ালে রঙিন স্বপ্নের সেতু—সব তার হাতে আঁকা।

তবু আলো, তবু নজর—সব কেবল নেতার দিকে।

মাননীয় অতিথি ঘণ্টাখানেক দেরিতে এসে লাল ফিতে কাটলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাজি ফাটল, ঢাক বেজে উঠল, আলো ঝলমল করে উঠল। ভিড় হাততালি দিল, মোবাইলে সেলফি তুলল। মঞ্চ থেকে ঘোষণা হল—
“এবারের পুজো আমাদের এলাকার গর্ব, জনগণের জয়!”

ঋজু এক কোণে দাঁড়িয়ে রইল। কারও ঠোঁটে তার নাম এল না, কারও মনে তার চেহারার ছায়াও ভেসে উঠল না। অথচ তার তুলি ছাড়া এই মণ্ডপ অন্ধকার খোলামেলা কাঠামো ছাড়া আর কিছুই হত না।

পাশে এক বৃদ্ধ এসে দাঁড়াল। হেসে ফিসফিস করে বলল—
“বাবা, আলোটা সুইচে নয়, তোর আঁকায়। কিন্তু কৃতিত্বটা চলে গেল মাইক্রোফোনে।”

ঋজু ঠোঁটে তিক্ত হাসি টেনে উত্তর দিল—
“আলো যদি সত্যিই আলো হয়, ওরা চাইলেই ঢাকতে পারবে না।”

রাত গভীর হল। ভিড় কমল। নেতা-মন্ত্রী চলে গেলেন। বাজির ধোঁয়া মিলিয়ে গেল। শুধু লাইটগুলো জ্বলছে, কিন্তু সেগুলো নিস্প্রাণ। যেন সাজানো প্রদর্শনীর মধ্যে প্রাণহীন আলোকবৃত্ত।

ঋজু ধীরে ধীরে প্রতিমার সামনে এগিয়ে গেল। খুব আস্তে বলল—
“মা, কেউ যদি না-ও বোঝে, তুমি তো বোঝো… আমার এই আঁকিবুকিই আসল আলো।”

হঠাৎ প্রতিমার ঠোঁট থেকে লাল কুমকুমের দাগ গড়িয়ে পড়ল তার কপালে। ঋজুর শরীর শিউরে উঠল। মনে হল, প্রতিমার নিঃশ্বাস তার গায়ের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে।

পরদিন সকালে মানুষ মণ্ডপে এসে অবাক হয়ে গেল। ঋজুকে আর কোথাও পাওয়া গেল না। কেউ বলল সে পালিয়েছে, কেউ বলল হারিয়ে গেছে। কিন্তু ভেতরে ঢুকেই সকলে চমকে উঠল—প্রতিমার চোখে হঠাৎ এক নতুন দীপ্তি ফুটে উঠেছে। সেই দীপ্তি কারও হাতে আঁকা নয়, কারও রঙে ধরা যায় না।

আর এক দেওয়ালে আচমকা উদয় হল এক রহস্যময় আঁকিবুঁকি, যা আগের রাতে ছিল না। তাতে লেখা—

“আলো নিভে যায় না। আলো হয়ে মানুষই মিশে যায় মাটির মধ্যে।”

ঋজুর নামটা আর কেউ নেয়নি, কিন্তু তার অলীক উপস্থিতি থেকে গেল প্রতিটি রঙের ভিতর, প্রতিটি আলোর ছটায়। বিসর্জনের দিনেও সেই আলো নিভল না।

 

Comments :0

Login to leave a comment