গল্প
আমাদের গ্রাম
মনীষ দেব
নতুনপাতা
লাউপাতার আঁকশি থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ছে শিশির — সবুজ পাতার গায়ে, ঘাসে ঘাসে। কচুপাতায় টলমল করছে শিশির বিন্দু। ভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে — শিউলী এসে পেড়ে নিচ্ছে রসের হাঁড়ি। নিকনো দাওয়ায় ধান মেলে দিচ্ছে নয়নতারা দাসী, আর আনজু বানুর মোরগ গুলি দাওয়ার চারপাশে ঘুর ঘুর করছে তাতে ভাগ বসাবে বলে। বৃষ্টিভেজা লাল টুকটুকে করমচার গাছে বাবুইয়ের আনাগোনা। কয়েক জোড়া শালিককে নিজের পান্তা থেকে ভাত ছড়িয়ে দিচ্ছে পরাণচাচা। এমনই ছিল জীবন নানা রঙের। জমিদার বাড়ির দাওয়ায়, গাছ পোতার পরে রথযাত্রার দিন কাঠামোর গায়ে খড় বাধতো হারান চিত্রকর। এমনই কোনও লাগানো বেলগাছের নীচে ষষ্ঠিতে বোধন হোত ‘উমা’র। কলাবাগানের কোনও নবপত্রিকায় নতুন কাপড় পড়িয়ে নদীতে স্নান করাতে যেত সপ্তমীর ভোরে সারা গাঁ। নীলদিঘি থেকে একশো আটটা লালপদ্ম তুলে আনা হোতে — প্রকৃতি থেকে প্রকৃতির কাছে ফিরে ফিরে যাওয়া।
কিন্তু, সেই ফেলে আসা প্রকৃতির কাছে আর ফেরা হবে না, কোনও আয়োজনেই। নীলদিঘিতে এখন ‘কোল্ডস্টোরেজ’। রথের মেলার মাঠ ‘রাইস মিল’। জীর্ণ-দীর্ণ রায়চৌধুরীদের জমিদারবাড়ি গুড়িয়ে মাথা তুলেছে — ‘রায় টার্মিনার্স’ কংক্রিটের কলোনী। নায়েব কাকার বাড়ি। গোঁসাই বাড়ি। দেওয়ান গাজীর বাড়ি, সব একে একে মাথা তুলেছে কংক্রিটের অরণ্য হয়ে। সভ্যতার কাছে বিকিয়ে গেছে — আমাদের কোকিল ডাকা ‘পৌষগ্রাম’। সভ্যতার কাছে হারতে হারতে প্রকৃতি আজ দাবানলে পুড়ে যাওয়া অরণ্যের মতো।
আমাদের গ্রাম আর পরবে না কাঁচের চুড়ি — ছুটে যাবে না রঙীন ঘূর্ণি হাতে। নীল আকাশে উড়বে না আর রঙীন ঘুড়ি — কাশবনের মাঠে হারিয়ে যাবে না ছোটবেলা। ঘুমপাড়ানি মাসী পিসি ফিরবে না আর গাঁয়ে।
Comments :0