গল্প
অনির ইচ্ছাপূরণ
সৌরীশ মিশ্র
নতুনপাতা
শনিবারের দুপুর। তিনটে বেজে গিয়েছে। ছোট্ট অনি, ওর বাবা, মা, ঠাকুরদা আর ঠাকুমার সাথে বসে আছে ওদের বাড়ির বসার ঘরে। ঘরে রেডিও চলছে। একটা এফ এম স্টেশন। ছোটোদের একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে ওতে। এই অনুষ্ঠানে সরাসরি ফোন করে অংশ নিয়ে স্কুল পড়ুয়ারা গান, আবৃত্তি এইসব শোনাতে পারে। অনিরও অনেকদিনের ইচ্ছা ও-ও অংশ নেয় এই অনুষ্ঠানটায়। একটা আবৃত্তি শোনায়। কিন্তু, এই অনুষ্ঠানটা এতোটাই জনপ্রিয় যে গত তিন মাস ধ'রে প্রতিটা শনিবার অনুষ্ঠান চলাকালীন টানা চেষ্টা করেও অনুষ্ঠানে লাইন পায়নি অনি। রেডিও স্টেশনের ফোন নাম্বারটা ডায়াল করলেই শুধুই ভেসে এসেছে এনগেজ টোন।
তবে আজ ব্যাপারটা পুরো অন্যরকম হোলো। তিনবারের বার ওদের বাড়ির ল্যান্ডলাইন টেলিফোনটায় অনি রেডিও স্টেশনের নাম্বারটা ডায়াল করতেই এনগেজ টোনের বদলে রিং হতে শুরু করল। অনি সাথে সাথে টেলিফোন সেটের স্পিকার বটনটা অন্ করে দিল, যাতে ফোনে কথাবার্তা হলে ঘরের সবাই তা শুনতে পায়। এর'ম করার কথা বলে দিয়েছিলেন আগে থেকেই অনিকে ওর বাবা।
দু'বার রিং শেষ হতেই ফোনের ওপার থেকে ভেসে এল এক ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বর। "হ্যালো..."
এই গলার স্বর খুব ভাল করেই চেনে অনি। এটা এই অনুষ্ঠানের আর জে স্নিগ্ধা আন্টির গলা।
"স্নিগ্ধা আন্টি বলছো, না?"
"হ্যাঁ। তুমি কে?"
"আমি অনিরুদ্ধ বলছি। বালিগঞ্জ থেকে। আমি না, একটা আবৃত্তি করতে চাই। আমি কি করতে পারি?"
"কেন নয়? তবে আগে বলো তুমি, তোমার পুরো নাম কি আর তুমি কোন ক্লাসে পড়ো অনিরুদ্ধ?"
"আমার পুরো নাম অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য। আর আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ি।"
"বা-বা, ক্লাস থ্রি! সে তো অনেক উঁচু ক্লাস! তা, অনিরুদ্ধ, তুমি কি কবিতা শোনাতে চাও?"
"আজ তো কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন, তাই আমি আবৃত্তি করতে চাই ওনার লেখা 'লিচু চোর'।"
"বা:। তা কবিতাটা মুখস্থ আছে তো তোমার?"
"হ্যাঁ, মুখস্থ আছে।"
"ঠিক আছে তবে। আমি একটু পরেই কবিতাটা বলব বলতে তোমায়, তুমি তখন খুব সুন্দর করে কবিতাটা বলবে আর এদিকে আমি সেটা রেকর্ড করে নেব। বুঝেছো তো?"
"হ্যাঁ বুঝেছি।"
মিনিট পাঁচেক লাগল কবিতাটা রেকর্ড করতে অনির। কবিতাটা একেবারে মুখস্থ থাকায় এবং আগেও বহুবার আবৃত্তি করা থাকায় কোনোই অসুবিধা হয়নি অনির আবৃত্তি করার সময়। রেকর্ডিং শেষ হতে আর জে স্নিগ্ধা অনিকে বললেন, "খুবই ভাল আবৃত্তি করেছো অনিরুদ্ধ। এবার ফোন লাইনটা ছেড়ে দাও তুমি। রেডিওটা শুনতে থাকো। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই বাজাবো তোমার আবৃত্তিটা। আবার ফোন কোরো। অনেক আদর নিও।"
"থ্যাংক ইউ স্নিগ্ধা আন্টি।"
"ওয়েলকাম সোনা।"
লাইনটা কেটে যায়।
আর সাথে সাথেই অনির ঠাকুমা আর মা জড়িয়ে ধরলেন অনিকে। ঠাকুরদাও পিঠ চাপড়ে দিলেন ওর। আর এদিকে অনিরুদ্ধর বাবা নিজের মোবাইল ফোনের রেকর্ডিং বটনটা অন্ করে দিয়ে রেখে দিলেন সেটা রেডিও-র পাশে, যাতে ছেলের আবৃত্তিটা রেকর্ড হয়ে যায় তাঁর ফোনে। আর ঐ কাজটা করতে করতেই তিনি বললেন, "এখন তো বিজ্ঞাপন হচ্ছে, এরপরই বোধহয় বাজাবে অনির আবৃত্তিটা।"
সত্যিই তাই হোলো। বিজ্ঞাপনটা শেষ হতেই কথা বলা শুরু করলেন আর জে স্নিগ্ধা। "ছোট্ট বন্ধুরা, তোমরা জানো তো আজ কিন্তু একটা খুব বিশেষ দিন। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছো তোমরা। আজ কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। জানো তো, এই একটু আগে আমাকে ফোন করেছিল তোমাদেরই এক বন্ধু বালিগঞ্জ থেকে। ওর নাম অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য। ক্লাস থ্রিতে পড়ে ও। ও আমাকে কাজী নজরুল ইসলামেরই একটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনালো। আমি রেকর্ডিং করে রেখেছি ওর করা আবৃত্তিটা। তোমরাও শোনো সেইটা এবার..."
আর এর পর মুহূর্তেই রেডিও থেকে ভেসে এল অনির কণ্ঠস্বর।
ঘরের সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতোনই শুনতে থাকল তা।
আর, ঐ রেকর্ডিং শেষ হওয়া মাত্র অনি সোফা থেকে উঠে পড়ল। পায়ে পায়ে সে এগিয়ে গেল ঐ ঘরের দেওয়ালে টাঙানো কাজী নজরুল ইসলামের বাধানো ছবিটার দিকে। সামনে দাঁড়াল সে ছবিটার। তারপর দু'হাত জোড় করে প্রণাম করল সে কাজী নজরুল ইসলামকে।
Comments :0