Editorial

গর্গের ভূত

সম্পাদকীয় বিভাগ

আসামের জনপ্রিয় গায়ক জুবিন গ‍‌র্গের সিঙ্গাপুরে অস্বাভাবিক মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পরেও গোটা আসাম জুড়ে তাঁর অনুরাগীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ-প্রতিবাদের বিরাম নেই। মৃত্যু সংবাদের প্রথম ধাক্কায় তারা শোকস্তব্ধ হলেও কোনও অবস্থাতেই এই মৃত্যুকে তারা মেনে নিতে পারেননি। ঘটনাক্রমের বিবরণ ও ব্যাখ্যার যত গভীরে প্রবেশ করেছেন তাই মনের মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। তারা বিশ্বাস করতে পারছেন না এভাবে জুবিনের মৃত্যু হতে পারে। ক্রমে এই ধারণা বদ্ধ হতে থাকে যে জুবিনের মৃত্যু স্বাভাবিক বা দুর্ঘটনাজনিত নয়, নিশ্চিতভাবে পরিকল্পনা করে তাঁকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা পরিকল্পিত সংগঠিত হত্যা। বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো অনুরাগীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এই মনোভাব। সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্র দাবি ওঠে তদন্ত করে হত্যা রহস্য উদঘাটনের এবং খুনি ও খুনের মদতদাতাদের চরম শাস্তির। পরিস্থিতি ক্রমশ এতটাই ঘোরালো হয়ে ওঠে যে আসামের বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বাধ্য হন শক্তিশালী তদন্ত টিম তৈরি করে তদন্তের নির্দেশ দিতে।
তদন্তের গতিপ্রকৃতিতে জুবিন অনুরাগীরা মোটেই সন্তুষ্ট নন। সে অসন্তোষের প্রতিফলন ঘটছে প্রতিনিয়ত প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মাধ্যমে। আসামের মানুষের প্রিয়তম গায়কের এমন আচমকা দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুতে সরকারের তাপ-উত্তাপহীন ঢিলেঢালা আচরণ অনুরাগীদের মনে সন্দেহ দৃঢ় হয় যে হয় সরকার বিষয়টাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না অথবা অপরাধীদের যে কোনও কারণেই হোক আড়াল করার চেষ্টা করছে বা ধামাচাপা দিতে চাইছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদী হিমন্ত বিশ্বশর্মার সরকারের সঙ্গে সেই অর্থে জুবিনের মধুর সম্পর্ক ছিল না। তাছাড়া জুবিন প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছেন তাঁর কোনও ধর্ম নেই, জাত নেই, দেশ নেই। দেশকালের উর্ধ্বে মানবতাবাদী। এমন মনোভাব ধর্মান্ধ-হিন্দুত্ববাদী ও উগ্র জাতীয়তাবাদীদের মোটেই পছন্দের নয়। বরং তারা মনে করে এমন মনোভাব অনুরাগীদের মাধ্যমে ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকলে হিন্দুত্ববাদীদের বিপদ। ধর্মীয় বিভাজন ও মেরুকরণের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকার যে স্বপ্ন দেখেন সেটা বানচাল হতে পারে। তাই জুবিন অনুরাগীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ-প্রতিবাদে হিমন্ত সরকার বেজায় বিরক্ত এবং ক্ষুব্ধ। তাই জুবিন অনুরাগীদের যে কোনও জমায়েত বন্ধ করার জন্য পুলিশ প্রশাসন অতি তৎপর হয়ে উঠছে। একাধিকবার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ-প্রতিবাদ দমনে পুলিশ লাঠি-কাঁদানে গ্যাসে সীমাবদ্ধ থাকেনি, গুলিও চালিয়েছে। শোকাহত মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগকে এভাবে দমন করার চেষ্টায় বিক্ষোভ আরও তীব্র হয়েছে। পাশাপাশি সন্দেহ দৃঢ় করেছে যে জুবিন হত্যা রহস্য সরকার জানে এবং সরকার অপরাধীদের রক্ষা করতে চাইছে। ফলে সরকারই পরিস্থিতিকে সরকার বিরোধী আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এখন বিশ্বশর্মা বলছেন এর পেছনে নাকি বিরোধীদের মদত আছে। এই বিক্ষোভ আন্দোলনকে তাই আগামী বছর নির্বাচন পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে চান। মুখ্যমন্ত্রীর এমন ভাষ্য অনুরাগীদের আবেগকে নিঃসন্দেহে আঘাত করেছে, আহত করেছে। দ্রুত তদন্ত সারার দিকে মন না দিয়ে শর্মাও এক গণশোকের আবহকে রাজনৈতিক স্রোতের দিকে ঠেলে দিলেন। মূল্য তাঁকে তো দিতেই হবে।

Comments :0

Login to leave a comment