ফ্লোটিল্লা অভিযান নিছক কয়েকটি জাহাজের সমুদ্র যাত্রা নয়, এ হলো ইজরায়েলের অবৈধ অবরোধের বিরুদ্ধে মানবতার এক দুর্বার চ্যালেঞ্জ। গাজার ২২ লাখ অবরুদ্ধ মানুষের কাছে জীবনদায়ী সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিশ্বের সাধারণ নাগরিকদের এই মানবতার যুদ্ধ আজ উন্মোচন করেছে এক চরম সত্য— একদিকে দাঁড়িয়ে আছে মার্কিন-মদতপুষ্ট ইজরায়েলি সামরিক শক্তি, আর অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে ন্যায়ের পক্ষে থাকা কোটি মানুষের ক্ষুব্ধ বিবেক।
সাম্প্রতিক 'গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিল্লা' এবং পূর্ববর্তী ২০১০ সালের 'গাজা ফ্রিডম ফ্লোটিল্লা'র ওপর বর্বর আক্রমণ প্রমাণ করে, কেবল স্থল বা আকাশসীমাই নয়, ভূমধ্যসাগরের আন্তর্জাতিক জলসীমাতেও ইজরায়েলের ফ্যাসিস্ত আগ্রাসন ঘটছে। ফ্লোটিল্লার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ২২ লাখ মানুষের কাছে খাদ্য, ওষুধ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করা— যাদের জীবন কেড়ে নিচ্ছে ইজরায়েলের ১৮ বছরের অমানবিক অবরোধ। কিন্তু বারবার দেখা গেছে, এই মানবিক প্রচেষ্টা ইজরায়েলি সামরিক জলদস্যুদের শিকার হচ্ছে।
২০১০ সালের ‘মাভি মারমারা’ হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এক লজ্জাজনক কালো অধ্যায়। আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইজরায়েলি কমান্ডোরা সরাসরি হামলা চালিয়েছিল নিরস্ত্র মানবাধিকার কর্মীদের ওপর। ১০ জন নিরীহ কর্মী, সাংবাদিক ও ত্রাণদাতার রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল সেই জাহাজ। ইজরায়েলের এই ঠান্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড বিশ্বজুড়ে যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল, তা ইজরায়েলের পাশবিক চেহারাকে নগ্নভাবে উন্মোচিত করেছিল সেদিনও।
সাম্প্রতিক ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিল্লা’ অভিযানেও একই ক্ষমার অযোগ্য অপরাধের পুনরাবৃত্তি দেখা গেল। গ্রেটা থুনবার্গের মতো বিশ্ববিখ্যাত পরিবেশকর্মী সহ মানবাধিকার কর্মী, চিকিৎসক এবং আইনজীবীদের অপহরণ এবং গ্রেপ্তার করা হলো। ইজরায়েল এই মানবিক মিশনকে 'সন্ত্রাসবাদের সমর্থক' আখ্যা দিয়ে তার স্বঘোষিত সার্বভৌমত্বের কথা বলছে, যা বিশ্বজনমতের কাছে এক জঘন্য মিথ্যাচার ও প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। বিশ্ববাসী একবাক্যে এই কাজকে আন্তর্জাতিক আইনের নির্লজ্জ লঙ্ঘন হিসাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। ফ্লোটিল্লার ওপর এই আক্রমণ আজ বিশ্বের সামনে পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, গাজার মানুষ কী ভয়াবহ অত্যাচারের শিকার। রাষ্ট্রসঙ্ঘও ইজরায়েলের এই অবরোধ ও গণহত্যা ভাঙতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ। ফ্লোটিল্লা অভিযান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, আন্তর্জাতিকভাবে সুরক্ষিত মানবিক সাহায্য বিতরণের অধিকার কীভাবে ইজরায়েলের জায়নবাদী সরকার পদদলিত করে চলেছে।
আন্তর্জাতিক জলসীমায় সামরিক হস্তক্ষেপ এবং অসামরিক জাহাজের উপর হামলা কেবল আন্তর্জাতিক আইনই নয়, সভ্যতার মৌলিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে এক সরাসরি আক্রমণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘অন্ধ সমর্থন’ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর লজ্জাজনক নীরবতার সুযোগ নিয়ে দু’কান কাটা নেতানেয়াহু আজ বিশ্ব জনমতকে তুচ্ছ করে চলেছে।
সময় এসেছে নীরবতা ভাঙার, কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার। ফ্লোটিল্লা অভিযান মানবতার পক্ষে এক বিস্ফোরক আহ্বান। এই অভিযান ইজরায়েলের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে বিশ্ব মঞ্চে উন্মুক্ত করেছে। এখন কেবল নিন্দা জানানো যথেষ্ট নয়। আজ বিশ্বজুড়ে দাবি উঠেছে, গাজার ১৮ বছরের অবৈধ ও অমানবিক অবরোধ অবিলম্বে শর্তহীনভাবে প্রত্যাহার করতে হবে। সেখানে গণহত্যা বন্ধ করে প্যালেস্তাইনের দখলকৃত ভুমি ইজারেয়েলকে ছাড়তে হবে। একটি নিরাপদ ও স্থায়ী ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, যেখানে ইজরায়েলের সামরিক দস্যুদের হস্তক্ষেপের কোনও সুযোগ থাকবে না। আন্তর্জাতিক জলসীমায় জলদস্যুবৃত্তি এবং নিরস্ত্র মানবাধিকার কর্মীদের ওপর হামলার জন্য ইজরায়েলি জায়নবাদী রাষ্ট্রপ্রধান নেতানেয়াহু’র বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ইউরোপের তুরস্ক, ইতালি, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স, গ্রিস এবং আয়ারল্যান্ড থেকে শুরু করে এশিয়ার মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ, ভারত এবং দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা সহ বিভিন্ন দেশে কোটি কোটি মানুষের ক্ষোভের আগুন জ্বলছে।
বিশ্বজুড়ে এই মানবতার পক্ষে এই গণবিস্ফোরণ আজ এক কঠিন বার্তা দিচ্ছে— ইজরায়েলি হিংস্রতার এই সাম্রাজ্য চূর্ণ হবেই, কারণ মানবিকতার উন্মুক্ত তরবারি আজ বিশ্বজনমতের হাতে।
Editorial
ফ্লোটিল্লা বনাম জলদস্যু নেতানেয়াহু

×
Comments :0