মানস গুমটা
‘নিভন্ত ওই চুল্লিতে মা একটু আগুন দে’
বেঁচে নেই অভয়া। আমাদের মেয়ে, আমাদের ঘরের মেয়ে অভয়া, একবছর আগে নৃশংসভাবে খুন হয়েছে তার কর্মস্থলে। ডিউটির মধ্যে। জানা যায় অভয়ার চোখে জল ছিল না। ছিল রক্ত। অবশ্য গলাটিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হলে চোখে জল থাকার কথা নয়। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, ভয়ের রাজনীতি আর লালসার শিকারে ক্ষত-বিক্ষত শরীরটা শায়িত ছিল পাটপাট করে বিছানো-পুলিশের কথায় নীল (?) বাবা-মায়ের কথায় সবুজ রঙের চাদরে ঢাকা তোষকে। আরও জানা যায় দূর থেকে দেখেই নাকি অভয়ার মৃত্যু সম্বন্ধে সুনিশ্চিত হয়েছিল হাসপাতালের প্রশাসন। তাই মনে করেনি সিপিআর দেওয়ার দরকার-মায় স্টেথোস্কোপ দিয়ে হার্ট সাউন্ড শোনার প্রয়োজনীয়তা।
অপরাধীরা এখনো মিশে আছে সমাজে...
যে প্রশাসক সাত সকালেই বলেছিল আপনার মেয়ে অসুস্থ-তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আসুন, যে প্রশাসক জানিয়েছিল মেয়েকে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যে প্রশাসক মৃত্যু সুনিশ্চিত জেনে! আত্মহত্যার বার্তা ছড়িয়েছিল দূর দিগন্তে, লাল জামা সাইনিং টাক নামে কুখ্যাত হয়ে ওঠা ফিঙ্গার প্রিন্ট বিশেষজ্ঞের উপস্থিতিতে যে সমস্ত মানুষ ওই সেমিনার রুমে মাছের বাজার বসিয়েছিল, উদ্বেগ যন্ত্রণায় ক্ষত বিক্ষত হতে থাকা বাবা-মা কে যারা তিন ঘণ্টা বসিয়ে রেখেছিল সেমিনার রুমের বাইরের বেঞ্চে, যে প্রশাসকরা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অর্ডার ছাড়াই সূর্যাস্তের পর পোস্ট মর্টেম করিয়েছিল, যাদের চূড়ান্ত অবহেলায় এফআইআর হয়েছিল মধ্যরাতে, বন্ধু, সহপাঠী, সহকর্মী, পাড়া, প্রতিবেশী, আত্মীয়, স্বজন— এমনকি মা-বাবাকেও ফুল দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে, মৃতদেহ ছিনতাই করে, লাইন ভেঙে, যারা সেই রাতেই পুড়িয়ে দিয়েছিল অভয়ার মৃতদেহ। যে লুম্পেন বাহিনী স্বাধীনতার রাতে গোটা হাসপাতাল চত্ত্বর লন্ডভন্ড করে এগিয়েছিল ওই সেমিনার রুমের দিকে— এমনকি যে প্রশাসকরা ঠিক পরের দিনই, পাশের ঘরের দেওয়াল ভাঙার আদেশনামায় সই করেছিলেন। তাঁরা সবাই— হ্যাঁ তাঁরা সবাই এখনো— কবি শামসুর রহমানের কথার একটু পরিবর্তন করে বলা যায় "খাচ্ছে দাচ্ছে ঘুরে বেড়াচ্ছে, চকচকে ব্লেডে দাড়ি কামাচ্ছে"।
‘বোঝাপড়া’ কী শুধুই অভিযোগ
যে তদন্তকারী সংস্থার প্রথম স্ট্যাটাস রিপোর্টে বিচলিত বোধ করেছিলেন সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারকগণ— তারাই সময়মতো সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দিতে ব্যর্থ হবে এবং সে কারণেই তথ্য প্রমাণ লোপাটে মূল অভিযুক্ত আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল ও টালা থানার ওসি জামিন পেয়ে যাবে এটা বিশ্বাস করা যায়? রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া একজনকে, ব্যস্ত ওয়ার্ডের পাশে থাকা সেমিনার রুমে কেউ এসে ধর্ষণ করল, খুন করল— আর কেউ জানতে পারলো না? তার চিৎকার কেউ শুনতে পেল না? সেন্ট্রাল ফরেন্সিক ল্যাবরেটরি হত্যার স্থান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও সিবিআই নিরুত্তর কেন? এই হত্যাকাণ্ড একজনের কাজ বলে কেউ বিশ্বাস করে? মানুষ জানতে চায় বিরলের মধ্যে বিরলতম এই হত্যার রহস্য কবে উন্মোচিত হবে। প্রশ্নের মুখে ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশের সর্বোচ্চ তদন্তকারী সংস্থা। প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে তদন্তের নামে প্রহসন চলছে না তো? তদন্তের গতিতে কেন শামুকও লজ্জা পাবে? তদন্তের গতি প্রকৃতিতে সাধারণ মানুষের আস্থা বিশ্বাসে চিড় ধরা কি ভারতের গণতন্ত্রের পক্ষে অশনি সংকেত নয়? মানুষ প্রশ্ন করেই চলেছেন "আর কবে"। আর কত অপেক্ষা করতে হবে ন্যায়বিচার পেতে। এই সময়কালে একাধিকবার রাজ্যে এসেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী,স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রী এসেছিলেন হত্যাকাণ্ডের কিছু দিন পরেই। কিন্তু অভয়ার ন্যায়বিচার পাওয়ার ব্যাপারে কার্যত কোনও আশ্বাস কারোর থেকে পাওয়া যায়নি। সর্বস্ব হারানো অভয়ার বাবা-মাকে একটু সময় দেওয়া কি খুব অসম্ভব ছিল? রাজ্যের বিরোধী দলনেতা কি একবারের জন্যেও বিধানসভায় অভয়ার বিচারের দাবি তুলেছেন? রাজ্যের বিরোধী দলের নির্বাচিত সাংসদরা কি বিগত একবছরে সংসদে ন্যায়বিচারের দাবি তুলেছেন? অবশ্য যে দলের সমর্থকরা জেল থেকে বেরোনো ধর্ষককে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেয়,তাদের থেকে বিশেষ কিছু আশা করা যায় না।
একদিকে তথ্য প্রমাণ লোপাট করে দুষ্কৃতি অপরাধীদের পক্ষে দাঁড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত রাজ্য প্রশাসন। এবং রাজ্যের ভূমিকায় কেন্দ্রের হিরন্ময় নীরবতা, তদন্তের শ্লথতা কেন্দ্র-রাজ্য-সিবিআই বোঝাপড়ার অভিযোগকেই প্রতিষ্ঠিত করছে বলে হয়।
‘কণ্ঠ যত করবে রোধ-বাড়বে তত প্রতিরোধ’
কার্যত দুষ্কৃতীদের মুক্তাঞ্চল বলা যায় আমাদের রাজ্যকে। দুর্নীতি আর ভয়ের রাজনীতি বর্তমান শাসকের নীতি। ঐতিহ্যপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর দিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ি চালিয়ে দেবে ভাবা যায়? একটা বিধানসভা উপনির্বাচনে জয়ের উল্লাসে আমাদের দেখতে হলো ছিন্নভিন্ন হয়ে মাংসপিণ্ডে পরিণত হওয়া তামান্নাকে। অতীতে সরকার আমাদের জানিয়েছিল পার্ক স্ট্রিটের ঘটনা সাজানো। কৃষ্ণনগরের ঘটনায় ‘ভালোবাসা’ ছিল। কামদুনি ধর্ষণের বিচার চেয়ে প্রতিবাদীদের জুটেছিল মাওবাদী তকমা। সেই ধারাতেই ন্যায়বিচারের দাবিতে অনশনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা শাসকের কাছে মাতাল, কসবা কাণ্ডে ধর্ষিতার অপরাধ বিকাল ৪টের পরেও সে কেন থেকে গিয়েছিল তার নিজের কলেজে। অন্যদিকে প্রতিবাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে দাঁত-নখ বার করে প্রতিনিয়ত আক্রমণ করে যাচ্ছে প্রশাসন। অবস্থান অনশনে জলের গাড়ি, বায়ো টয়লেট ঢুকতে না দেওয়া, মাথার উপরে ত্রিপল টাঙাতে বাধা দেওয়ার মতো অমানবিক আচরণ আমরা দেখেছি এই সময়কালে। মিছিল ডাকলেই ১৬৩ ধারা জারি করা, সরকারি কার্নিভালে ডিউটিরত ডাক্তারকে পুলিশ স্টেশনে আটকে রাখা, মেডিক্যাল কাউন্সিলকে ব্যবহার করে রেজিস্ট্রেশন কেড়ে নেওয়ার ভয় দেখানো, প্রতিবাদী জুনিয়ার ডাক্তারদের বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়ে হেনস্তা করা, কাউন্সেলিংয়ে পাওয়া পোস্টিং অন্যায়ভাবে বদলে দেওয়া সহ নানাভাবে ক্রমাগত প্রশাসন চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রতিবাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করার। তবে নাছোড় নাগরিক সমাজ রাস্তাকেই রাস্তা হিসাবে বেছে নিয়ে বার্তা দিচ্ছে-"কণ্ঠ যত করবে রোধ-বাড়বে তত প্রতিরোধ"।
ইতিহাস লেখা চলবে ন্যায়বিচার না পাওয়া পর্যন্ত
ঘটনার দিন রাত্রে ডিওয়াইএফআই, এসএফআই নেতৃত্ব এবং যৌথ মঞ্চের চিকিৎসকরা অভয়ার মৃতদেহ ছিনতাই আটকানোর চেষ্টার মাধ্যমে যে লড়াই শুরু করেছিল— সেটাই গণ জাগরণে পরিণত হবে আমরা কেউ ভেবেছিলাম? আমরা কি ভেবেছিলাম ১৪ আগস্ট রাত্রে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে আসবেন? যে মানুষ কোনোদিন স্লোগানে গলা মেলাননি, যে মানুষ কোনোদিন মিছিলে হাটেননি তাঁরাও প্রতিবাদের উত্তাল বহ্নিশিখা জ্বালিয়ে যাবেন? আমরা কেউ ভেবেছিলাম শহর থেকে গঞ্জ, গঞ্জ থেকে গ্রামের রাত দখল নেবে মানুষ? আমরা দেখেছি পাগলের মতো মিছিল খুঁজে ফেরা মানুষ। সমাজের সব অংশের, সব স্তরের, ভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির, এমনকি শাসক দলের সমর্থক,শাসক দলকে ভোট দেন এমনও মানুষও ছিলেন সেই দলে।
চলমান ইতিহাস রচনার পথে আমরা দেখলাম চোদ্দ তলার শাসকের চোখে চোখ রাখা জুনিয়র ডাক্তারদের পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের শিরদাঁড়া উপহার দেওয়া। আমরা দেখলাম হেনস্তার উদ্দেশ্যে ডেকে পাঠানো সিনিয়র চিকিৎসকদের লালবাজার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসা। জুনিয়র ডাক্তারদের স্বাস্থ্যভবনের সামনের অবস্থানের দিনগুলোতে আমরা দেখেছি মানুষের আবেগ ও ক্রোধের মহা সংমিশ্রণ। একই সঙ্গে বিরামহীন নতুন নতুন স্লোগান তৈরি করা-স্লোগান দেওয়াও রাজ্যবাসীর নতুন অভিজ্ঞতা। আমরা দেখেছি কালীঘাটে সর্বোচ্চ প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা ভেস্তে যাওয়ায় বিচার না পাওয়ার যন্ত্রণায় ক্ষত বিক্ষত হতে থাকা জুনিয়র ডাক্তারদের কান্না। অন্যদিকে দশ দফা দাবিতে ধর্মতলায় ১৭ দিনের নিজের জীবন বিপন্ন করা প্রত্যয়ী অনশন আর মানুষের স্রোতে পথ ভাসানো অসংখ্য মিছিল দেখেছে মানুষ। প্রশাসন ওদের অনশন থেকে উৎসবে ফিরতে বলেছিল। ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দ্রোহের উৎসবে থাকবে।
রাজ্যবাসী অবাক দৃষ্টিতে দেখলো ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান-মহামেডানের সদস্য সমর্থকরা সল্টলেক স্টেডিয়ামের বাইরে হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছে "উই ওয়ান্ট জাস্টিস"। দেখলো কলেজে কলেজে গণ কনভেনশনে নাগরিক সমাজের উপচে পড়া ভিড়। চিকিৎসক ও নানা নাগরিক সংগঠনের ডাকে "হাইল্যান্ড পার্ক থেকে শ্যামবাজার" দীর্ঘ পথে স্লোগান মুখরিত উত্তাল মশাল মিছিল। অন্যদিকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন সমূহের অভয়া মঞ্চ ও চিকিৎসকদের যৌথ মঞ্চের ডাকে ইতিহাস তৈরি করা "এক লক্ষ্যে এক লক্ষের দীপ্ত মিছিল", প্রতিস্পর্ধী "দ্রোহের কার্নিভাল", "জনতার চার্জশিট", ডোরিনা ক্রসিংয়ে লাগাতার দিনরাতের অবস্থান বিক্ষোভ, দ্রোহের বড়দিন, দ্রোহের নববর্ষ, জন্মদিনে মৌন মিছিল। প্রতিমাসের ৯ তারিখে রাজ্যের নানা প্রান্তে অভয়া মঞ্চের প্রতিবাদী সভা, সমাবেশ, মিছিল।
‘...শোনো বাইরে এসো, লণ্ঠনটা বাড়িয়ে দাও’
রাগ, ক্রোধ, ঘৃণা, শোকের স্মৃতি নিয়ে আবার ফিরছে ৯ আগস্ট। অপরাধীরা এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের সমাজে। এই সমাজ নির্বিকার থাকতে পারে? মানুষ জানে অভয়ার ন্যায়বিচার মানে অভয়াদের ন্যায়বিচার। আর একটাও অভয়া হতে না দেওয়ার লড়াই। ভিন্ন ভিন্ন অত্যাচার, অন্যায়ের বিচার চাওয়া। তাই আবারও স্বাধীনতার রাত দখল করতে চান তাঁরা। চলছে প্রস্তুতি শহর, গঞ্জ, গ্রাম, মহল্লা,পাড়ায়। প্রতিবাদী নাগরিক সমাজের স্পর্ধা বলছে ‘নো পাসারন’-পার পাবে না।
এখন লণ্ঠন বাড়িয়ে দেওয়ার সময়। বৃত্ত বাড়িয়ে আরও বেশি মানুষকে লড়াইয়ের ময়দানে নিয়ে আসার সময়। ছোটখাট মতের অমিল সরিয়ে রাখার সময়। স্বাগত জানানো দরকার যাঁরা এই লড়াইয়ে শামিল হতে চান তাঁদের। তবে রাখতে হবে সতর্কতা-কোনো স্বার্থ সন্ধানী, সুযোগ সন্ধানী ঢুকে না পড়ে। প্রতিটি সহযোদ্ধাকে আগলে রাখতে হবে পরিবারের সদস্যদের মতো। থাকতে হবে রাস্তায় সব প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত। তদন্তকারী সংস্থার রাজ্য দপ্তরে একাধিকবার মানুষের ক্ষোভ আছড়ে পড়ছে। রাজ্যের স্বৈরাচার ভেবে নিয়েছিল সময় কিনে, কথার জাগলারিতে গুলিয়ে দিলে মানুষ আর রাস্তায় নামবেন না, মিছিল করবেন না, ভুলে যাবে সব যন্ত্রণা। সেই ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করছে মানুষ। এক বছরকাল পেরোলেও এত মানুষ, এত সভা, এত মিছিল। আরো একবার নাগরিক সমাজ বার্তা দিতে চায়-তাঁরা কোনও সমঝোতায় রাজি নন। তাই আবার হয়েছে রাত দখলের প্রস্তুতি। ডাক এসেছে "কালীঘাট চলো"। আমি নিশ্চিত রাজ্যবাসী দেখবে "খোলা বুক, খোলা মন, ভৈরবে উল্লাসে তারা আসে। দলে দলে আসে। কেঁপে ওঠে রঙ্গশাল, ভেঙে পড়ে নিষিদ্ধ তোরণ। পরাক্রান্ত মিছিলের দুর্জয় পদাঘাতে রাজপথে গড়ায় মুখোশ"।
Comments :0