ভয়াবহ বন্যার ক্ষত আজও শুকোয়নি জলপাইগুড়ি জেলার। হাজারো পরিবার ঘরছাড়া, ভিটেমাটি বালির নিচে, রুজি-রোজগারের পথ বন্ধ। এই বিপর্যয়ের আবহেই জেলায় এসে পড়েছে আলোর উৎসব দীপাবলি। কিন্তু এবারের উৎসব জলপাইগুড়িতে আলো নয়, বরং ছায়া ফেলেছে। একদিকে বন্যার চরম আর্থিক ধাক্কা, অন্যদিকে হাইকোর্টের নির্দেশে আতশবাজি বিক্রি নিষিদ্ধ হওয়ায় পরিবেশ একেবারেই পাল্টে গেছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই পুলিশ-প্রশাসন জেলার বিভিন্ন স্থানে সব ধরনের অবৈধ বাজির দোকান বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে, অন্যান্য বছর দীপাবলির আগে যে আলো-ঝলমলে মেলা বসত, এবছর তা অনুপস্থিত। শহরের রাস্তায় বন্যার কাদামাটি আর নিস্তব্ধতা। জলপাইগুড়ি, ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, বানারহাট, নাগরাকাটার মতো বড় বাজারগুলোতেও আলো, প্রদীপ ও সাজসজ্জার সামগ্রী বিক্রিতে যে রমরমা ব্যবসা চলত, এবছর ছবিটা তার ঠিক উল্টো।
আলোর ব্যবসায়ী অপূর্ব বসাকের আক্ষেপ, ‘‘বিক্রি প্রায় নেই বললেই চলে, ক্রেতারা আসছেনই না।’’ সাধারণ মানুষ বলছেন, বন্যায় মানুষের ঘর ভেসে গেছে, তাদের কাছে এখন আলোর চেয়ে জীবিকার আলোই বেশি প্রয়োজন। জলপাইগুড়ি শহরের দিনবাজার এলাকার মারওয়ারি সম্প্রদায়ের মানুষ প্রতি বছর কলাগাছ ও বাঁশের কঞ্চিতে প্রদীপ ও আলোর মালা দিয়ে যে ঐতিহ্যবাহী আলোকসজ্জা করতেন, এবছর তাতেও ভাটা।
প্রদীপ ব্যবসায়ী দীপক পালের কথায়, আগের তুলনায় বিক্রি প্রায় চারভাগের একভাগে নেমে এসেছে। বাজারে নানা ধরনের রঙিন লাইট ও আধুনিক আলোর পসরা থাকলেও, ক্রেতার অভাবে উৎসবের আলো যেন ফিকে। মাটির প্রদীপের চাহিদা অনেকটাই কমেছে টুনি লাইটের চাহিদায় বেড়ে যাওয়ায়। টুনি লাইটের আলোতেই এখন কম খরচে বাড়ি সাজাতে চান অনেকেই। মোমের প্রদীপও বাজার ছেয়ে ফেলেছে। তার মধ্যেই চাহিদা বাড়ছে এই জলপ্রদীপের। এই প্রদীপ তেলের বদলে সামান্য জল পেলেই জ্বলে ওঠে। তাই প্রদীপর চাহিদা বেড়েছে। এই ম্লান সময়েও ঐতিহ্যকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করছেন মৃৎশিল্পীরা। ধূপগুড়ির পালপাড়ার মৃৎশিল্পী সন্তোষ পাল প্রায় সতেরো বছর ধরে মাটির প্রদীপ তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি জানান, এবছরও বিভিন্ন ডিজাইনের প্রদীপের অর্ডার পেয়েছেন, কিন্তু কাঁচামালের দাম বাড়ায় লাভ কম হচ্ছে। তবুও তিনি ও তাঁর পরিবার দিনরাত পরিশ্রম করছেন দীপাবলির বাজারের জন্য। সন্তোষবাবুর কথায়, "ডিজিটাল যুগে এক বোতামে আলো জ্বলে উঠলেও, মাটির প্রদীপের আলোয় যে ঐতিহ্য আর আন্তরিকতা আছে, তা কখনও ম্লান হয় না।" বন্যার ক্ষতবিক্ষত জলপাইগুড়ি জেলা যখন ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে ব্যস্ত, তখন মাটির প্রদীপের কোমল আলোয় মানুষ যেন খুঁজছে আশার দীপ। দীপাবলির এই আঁধার সময়ে মাটির প্রদীপই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে— আলোর জয় অনিবার্য।
Diwali 2025
মাটির প্রদীপের আলোয় কটাবে কি জীবনের অন্ধকার, প্রশ্ন ব্যবসায়ীদের

×
Comments :0