শারদীয়া ১৪৩১
গল্প
নতুনপাতা
কুমারী পুজো
তুষার বসু
দেখতে দেখতে সপ্তমীর পুজো শেষ হয়ে গেলো। পন্ডিতদাদু পুজোর আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। দুর্গামূর্তির দিকে একবার দেখে চোখ বুজে প্রণাম করে সরে এসে গম্ভীর কন্ঠে ডাকলেন - কুড়ানি, এই কুড়ানি। বছর নয়েকের মেয়েটি পূজামণ্ডপের নিচে একধারে চুপচাপ বসেছিলো। দৌড়ে সামনে এসে বলল - দাদু, ডাকছো? - হ্যাঁ। যা একবার ভেতর বাড়িতে যা। বল, আমার পুজো শেষ হয়েছে।সব গোছগাছ করে নিতে। আদেশ শুনেই কুড়ানি এক দৌড়ে ভিতর বাড়িতে চলে গেলো। -ও ঠাকমা, দাদুর পুজো হয়ে গেছে। সব গুছিয়ে নিতে বলল।
কুড়ানির মা নেই। বাবা কাজের ধান্দায় এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। তাই পন্ডিতদাদুর বাড়িতে তাকে রেখে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছে। বামুনবাড়িতেও ফাই ফরমাস খাটার জন্য এমন অল্পবয়স্ক ছেলে মেয়ের প্রয়োজন। তা সে কুড়ানির মতো নিচুজাতের হলেও।
কুড়ানি তাদের এঁটো বাসন মাজে, ঘরদোর মোছে, ঝাঁট দেয়, আবার সন্ধ্যে হলে পন্ডিতদাদুর পায়ে গরম তেল মালিশ করে দেয়।
পন্ডিতদাদু ভিতর বাড়িতে গেলে কুড়ানিও পিছন পিছন যায়। সারাদিন উপোস থেকে পুজো করে উঠে পন্ডিতদাদু যে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে কুড়ানি তা বেশ বুঝতে পারে। দাদু তক্তাপোশে বসলে সেও মেঝেতে বসে পড়লো। পুজোর দিন, বাড়ি ভর্তি লোকজন। হৈ-হুল্লোড় লেগেই আছে। সকলেই যে যার কাজে ব্যস্ত। দাদু যে এসে বসে আছে সেদিকে কারও খেয়াল নেই দেখে কুড়ানি বিরক্ত হয়ে উঠলো। ভিতরের ঘরের দিকে গিয়ে সে বললো -ও বড়োমা, মেজোমা, দাদু যে দালানের তক্তাপোশে এসে বসে আছে। খেতে দেবে না? -এই যাই, বলে দু’বৌ উঠে আসে শ্বশুরকে খাবার দিতে। পন্ডিতদাদু বেশ খুশি হন, বলেন, -তোর তো দেখছি সবদিকে নজর!
-কি করবো বলো, সবাই যে যার তালে আছে। বুড়ো মানুষটা যে উপোস করে বসে আছে, সেদিকে কারও খেয়াল আছে? তাই আমাকেই গিয়ে বলতে হলো। মৃদু হাসি ফুটে উঠলো পন্ডিতদাদুর মুখে।
খাওয়া দাওয়া সেরে তক্তাপোশের উপর বালিশটা নিয়ে শুয়ে পড়লেন পন্ডিতমশাই। কুড়ানি এসে বসল পায়ের কাছে। তেল দিয়ে পাদু’টো ঘসে ঘসে মালিশ করতে করতে বললো- দাদু, কাল ওষ্টুমির পুজো, না?
-হুঁ, কাল অনেক কাজরে মা।অষ্টমীর পুজো, কুমারী পুজো, সন্ধিক্ষণের পুজো।
-আচ্ছা দাদু, এবারে কে কুমারী হবে গো? শ্রেয়াদিদি?
হ্যাঁ, তাছাড়া আর কাউকে তো পাওয়া গেলো না। কি আর করা যাবে।
কুড়ানির চোখের সামনে ভেসে ওঠে গতবছরের কুমারী পুজোর দৃশ্য। শ্রেয়াদিদিকে কি সুন্দর করে সাজিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দাদু পুজো করেছিল। তারও খুব ইচ্ছে করে ওমনি করে সেজেগুজে চেয়ারে বসে পুজো নিতে। সবাই কেমন একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে থাকবে। ঢাক বাজবে, কাঁসি বাজবে, মা-মা বলে সবাই হাতজোড় করে প্রণাম জানাবে। বড্ড লোভ হয় কুড়ানির। - কেন দাদু আর কেউ রাজি হলোনা বুঝি? জিজ্ঞেস করলো সে।
-না:।
-আচ্ছা দাদু আমি হতে পারিনা?
-তুই? ধুর, তুই তো আর বামুন নোস। বলে একটু থামলেন পন্ডিতদাদু। তারপর বললেন - অবিশ্যি শাস্ত্রে এমন কোনও কথা বলা নেই। তবে কি জানিস এটাই চলে আসছে। আর কিছু বললেন না দাদু। কুড়ানিও মুখ নিচু করে দাদুর পায়ে তেল মালিশ করতে থাকে।
আজ অনেক ফুল লাগবে তাই অন্ধকার থাকতেই উঠে পড়েছে কুড়ানি। ভোরের শিরশিরে ভাব গায়ে লাগছে। আবছা অন্ধকারে সাদা সাদা শিউলি ফুলগুলো টপাটপ কুড়িয়ে নিতে থাকে সে। একটা কালো মতো কি যেন তার সামনে দিয়ে চলে গেলো। লাফ দিয়ে উঠে পড়ে কুড়ানি। হাতের ফুলপাড়ার আঁকশিটা বাগিয়ে ধরে। ওদিকে পন্ডিতদাদু আগেই উঠে পড়ে পুকুর থেকে স্নান করে উঠে আসছেন, মন্ত্রপাঠ করতে করতে। কালো ছায়াটা ওদিকেই গেলো না! দ্রুত সেদিকে এগোল কুড়ানি। দাদুকে আসতে দেখে কালো ছায়াটা থমকে গেছে। তারপর কুড়ানির বুকের ধুকপুকুনি বাড়িয়ে দিয়ে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সামনেই দাদুর পা। যে মুহূর্তে ফণাটা পিছনে হেলিয়ে ছোবল মারতে গেলো সাপটা, ‘'দাদু” বলে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে কুড়ানি সেই মুহূর্তেই আঁকশিটা দিয়ে আঘাত করলো সাপটার উদ্যত ফণার ওপর। ছিটকে দূরে গিয়ে পড়লো সাপটা। আর মন্ত্রপাঠ থামিয়ে অবাক বিস্ময়ে পন্ডিতদাদু তাকিয়ে থাকলেন কুড়ানির মুখের দিকে। প্রথম সূর্যের লালচে আভাটা এসে পড়েছে সেখানে।
লালপাড় শাড়ি পরে গলায় ফুলের মালা দুলিয়ে, দু'পায়ে লাল আলতা পরে কুড়ানি বসে আছে সেই চেয়ারটায়, যেখানে শ্রেয়াদিদি বসেছিল গতবছর। পন্ডিতদাদু কারো বারণ শোনেননি। তিনি জোর করে কুড়ানিকে সাজিয়ে দিতে বলেছেন, এনে বসিয়েছেন পুজোর আসনে। সবাই অবাক হয়ে দেখছে বামুনবাড়ির দুর্গাপুজোয় বাগদিদের মেয়ে কুড়ানিকে আসনে বসিয়ে পন্ডিত হরিশংকর তর্কবাগীশ উচ্চারণ করে চলেছেন-
শরণাগত দীনার্ত পরিত্রাণপরায়ণে।
সর্বস্যার্তি হরে দেবি নারায়ণি নমোস্তুতে।।
Comments :0