Rights for Specially Abled Persons

মর্যাদা নিয়ে বাঁচার দাবিতে সমাবেশ আমরাও পৃথিবীর সন্তান

উত্তর সম্পাদকীয়​

কান্তি গাঙ্গুলি
আপনারা অবগত তা সত্ত্বেও উল্লেখ করা প্রয়োজন, দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে দেশের প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষ যে প্রতিবন্ধী অধিকার আইন-২০১৬ অর্জন করেছেন, তা শুধুমাত্র একটি আইন নয়, বরং তা একটি নৈতিক দলিল, যা দেশের সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদ (সমতা), ১৫ নং অনুচ্ছেদ (বৈষম্যহীনতা) এবং ২১ নং অনুচ্ছেদ (জীবনের অধিকার) এবং প্রতিবন্ধী অধিকারের আন্তর্জাতিক সনদের (UNCRPD) মৌলিক দর্শনের ভিত্তিভূমির উপর রচিত।
এই আইন একদিনে আসেনি, রাস্তায় নেমে আন্দোলন করে তিনবার রৌদ্র-ঝড়-বৃষ্টি, দিল্লির প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহ উপেক্ষা করে আমাদের সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর পক্ষ থেকে প্রায় তিন হাজার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে আমরা পার্লামেন্ট অভিযান করেছি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমাদের দাবি পেশ করেছি। এর ফলে প্রথমে গঠিত হয়েছে প্রতিবন্ধী অধিকার আইনের ‘ড্রাফ্ট কমিটি’, ‘ড. সুধা কল কমিটি’। তারপর সমস্ত রাজনৈতিক দলের সাংসদকে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আইনের খুঁটিনাটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য উত্থাপিত বিলকে স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে পাঠানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন সীতারাম ইয়েচুরি, বৃন্দা কারাত প্রমুখরা।
কিন্তু এটা কাগুজে আইন হয়েই থাকলে হবে না, আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি দপ্তরের কোনও উদ্যোগই নেই। ‘পরিবার’ এর সর্বভারতীয় সভাপতি ডক্টর পঙ্কজ মারু একটা হিসাব দিয়েছেন। প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ বিষয় ডক্টর মারু বলেছেন, ২০১১-এর জনগণনার পর যেহেতু আর তা হয়নি এবং প্রতিবন্ধকতার বিভাগ (Category) যেহেতু ৭টা থেকে ২১টা হয়েছে, সেহেতু ২০১১ সালের ২.৬৮ কোটি প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা বেড়ে বর্তমানে কমপক্ষে অন্তত সাত কোটি মানুষ প্রতিবন্ধকতার শিকার। আর এই মানুষগুলোর জন্য ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে কেন্দ্রীয় বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ১২০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির মাথাপিছু বরাদ্দ বছরে মাত্র ১৬০ টাকারও কম। 
তাই প্রয়োজন আইনি লড়াই, রাস্তার লড়াই এবং মানুষকে সচেতন করা। সমস্ত ব্লক, জেলা শাসকের দপ্তরে সারা রাজ্য জুড়ে চলেছে ডেপুটেশন, বিক্ষোভ, এমনকি আইন অমান্য কর্মসূচিও। প্রয়োজন আরও বেশি সাধারণ মানুষের জনসমর্থন। দেশের প্রায় সাত কোটি প্রতিবন্ধী মানুষ এবং আরও ৬ কোটি বিরল রোগে (Rare Disease) আক্রান্ত মানুষ, তাদের পাশে দাঁড়ানো বামপন্থীদের নৈতিক কর্তব্য।
আইন যতই সুযোগ দিক না কেন, আইনের সুবিধাগুলো কী, সেই বিষয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গ, তাদের অভিভাবকরা, আন্দোলনকারীরা, আইনজীবীরা কেউই কি পর্যাপ্তভাবে সচেতন। কিন্তু সচেতনতা প্রচারের দায়িত্ব রাজ্যের প্রতিবন্ধী কমিশনারের, আরসিআই’র আঞ্চলিক শাখার, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট-এর আঞ্চলিক সেন্টারের। গত বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের রাজ্যে স্থায়ী কোনও প্রতিবন্ধী কমিশনার নেই। অথচ অটিজম, বহুবিধ প্রতিবন্ধকতা (Multiple Disability), মানসিক বা বুদ্ধিবৃত্তীয় প্রতিবন্ধকতা (Intellectual Disability), সেরিব্রাল পলসি - এই চার  রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা কিভাবে ন্যাশনাল ট্রাস্টের অধীনে আইনগত অভিভাবকত্ব পাবেন, সেই বিষয়ে অধিকাংশ অভিভাবক সচেতন নন। অনন্য প্রতিবন্ধীতা পরিচয়পত্র (Unique Disability Card) অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে অনেক কষ্ট করে পাওয়া গেলেও সেই কার্ড কখনোই অন্যন্য (Unique) নয়। কারণ রেল, আয়কর বিভাগ, ন্যাশনাল ট্রাস্ট - সর্বত্র আবার ভিন্ন ভিন্ন কার্ড করাবার জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে হয়। ২০১৬ সালে প্রতিবন্ধী আইন হওয়ার পর আমাদের দাবি মেনে ২০১৭ সালে সরকার ১ হাজার টাকার ‘মানবিক ভাতা’ প্রকল্প করেছিল। ওই ২০১৭ সালেই সরকার প্রথম দুর্গাপূজা কমিটিগুলিকে ১০ হাজার টাকা অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যা ২০২৫ সালে এসে হলো ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা। অথচ এই আট বছরে প্রতিবন্ধী মানবিক ভাতা ওই ১০০০ টাকাই থেকে গেল। অথচ অন্ধ্র প্রদেশ সরকার দেয় মাসিক ছয় হাজার টাকা, দিল্লি দেয় আড়াই হাজার টাকা, তেলেঙ্গানা সরকার দেয় তিন হাজার টাকা। তামিলনাড়ু  সরকার দেয় আড়াই হাজার টাকা। কিন্তু আমাদের রাজ্য সরকার সস্তা ভোট ব্যাঙ্কের রাজনীতি করতে গিয়ে সাত লক্ষ কোটি টাকা দেনা করলেও ছিঁটেফোটা বরাদ্দও প্রতিবন্ধীদের জোটে না। আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করছি, মানবিক ভাতা অন্তত পাঁচ হাজার টাকা করতে হবে। আর এই দাবির সমর্থনেই আজ আমাদের সমাবেশ।
একশো দিনের কাজ প্রকল্পে জলপাইগুড়ি জেলায় একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকেও যুক্ত করা হয়নি। আমরা কলকাতা হাইকোর্টের উত্তরবঙ্গ সার্কিট বেঞ্চে মামলা করে আমাদের পক্ষে রায় এনেছি।
এখন লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে সামনে দুটো পথ খোলা আছে। এক নম্বর পথ হচ্ছে, রাস্তায় নেমে লড়াই আন্দোলন, এমনকি আইন অমান্য কর্মসূচি সংগঠিত করা। আলোকিত সভ্যতা দেখুক, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ হচ্ছে। এইটুকু তো আর দেখার বাকি আছে! আর দ্বিতীয় পথ হচ্ছে তথ্য জানার অধিকার সঙ্গক্রান্ত আইনের মাধ্যমে সমস্ত দপ্তরের প্রতিবন্ধকতা বিষয়ক তথ্য জোগাড় করে শুভানুধ্যায়ী আইনজীবীদের মাধ্যমে  জনস্বার্থ মামলা করে প্রতিবন্ধী অধিকারের পক্ষে রায় আনতে হবে এবং সেই রায় কার্যকরী করার জন্য পুনরায় আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
ইতিমধ্যে অবশ্য আইনি লড়াইয়েও এই বিষয়ে অনেক যুগান্তকারী রায় দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। ‘রাজীব রাতুরি বনাম ভারত সরকার’-এর  মামলায় প্রতিবন্ধীদের প্রবেশ-গম্যতার (Accessibility) ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট কেন্দ্র এবং রাজ্যকে প্রবেশগম্যতা সুনিশ্চিত করার জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বাস্তবায়িত করতে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়েছে। ‘ডক্টর বিকাশ কুমার বনাম ইউপিএসসি’ এবং অন্যান্যদের মামলায় (২০২১) সালে প্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীরা রাইটার বা অনুলেখকের সাহায্য নিতে পারবে বলে ঘোষণা করেছে সর্বোচ্চ আদালত। সুপ্রিম কোর্টে এইরকম বহু ইতিবাচক রায় হয়েছে। তবে ‘রজনীশ কুমার পান্ডে বনাম ভারত সরকার’ মামলায় (২০২৩) সমস্ত জেনারেল স্কুলে অন্তত একজন বিশেষ শিক্ষকের নিয়োগের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট দেশের ৩১টি রাজ্যকে এই মামলায় যুক্ত করে এবং শেষমেশ ২০২৩ সালে রায় ঘোষণা করে, যেখানে বলা হয় সমস্ত সাধারণ বিদ্যালয় অন্তত একজন বিশেষ শিক্ষক নিয়োগ করতেই হবে, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার (Inclusive Education) মূল উপাদান। এই নির্দেশ অমান্য করলে স্কুলের অনুমোদন বাতিল হবে এবং পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানা হবে। কিন্তু এই লেখাটা অর্ধেক লেখার পরে মনে এলো, এই বছর কৃষ্ণনগরে নদীয়া জেলা সম্মেলন থেকে ফেরার সময়কার কথা। স্মৃতির সঞ্চয়, বৃদ্ধ বয়সে যেন মনকে তোলপাড় করে তোলে।
আমার বয়সের কারণে সংগঠকরা গাড়ি ছাড়া কোথাও আমাকে দীর্ঘ রাস্তায় যাওয়া ঠিক বলে মনে করেন না। ওরা জানেন না, প্রায় আট বছর আমি জঙ্গলমহল ও অন্যত্র আত্মগোপন করেছিলাম। যাক সেসব কথা। কৃষ্ণনগর জেলা সম্মেলনে অবশ্য গিয়েছিলাম ট্রেনের রিজার্ভ কামরায়, ফিরতে দেরি হয়ে গেল। ফিরতি ট্রেন তখন স্টেশন ছেড়ে গেছে, নদীয়া জেলার সম্পাদক বিকাশ তখন প্রায় হাতে-পায়ে ধরেছে — "দাদা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিচ্ছি"। আমি কোনোক্রমে ওদের নিশ্চিন্ত করে রবিবারের বেশ ফাঁকা লোকাল ট্রেনে জানালার ধারের সিটে বসে গেলাম। দেখলাম আদিগন্ত গঙ্গা নদীর তীরের জমি জুড়ে পেকে উঠেছে আমন ধান। স্টেশনে উঠছে হরেক রকম হকার। সঙ্গী একজনকে বলে মশলা মুড়ি খেলাম। কি অপূর্ব স্বাদ, মনটা আনমনা হয়েছিল — মনে পড়ছিল প্রথম যৌবনের বিক্ষিপ্ত স্মৃতি! হঠাৎ কানে এল অদ্ভুত মিষ্টি গলার গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত – ‘‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে, দেখতে আমি পাইনি ওগো, দেখতে আমি পাইনি।’’ গানের মধ্যে যেন পেলাম ছলাৎছল ঢেউয়ের অফুরন্ত প্রাণশক্তি। গানটা শুনে মনে হলো আমি বুঝি এই আলোকিত পৃথিবীর বুকে নতুন কিছু দেখছি। আত্মপরিচয়ের কিছুটা সুরও যেন সামান্য জেগে ওঠে আমার বুকে। যখন দেখি দু’জন সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন নারী ও পুরুষ লাঠি ঠুকে এই অসামান্য রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করে চলেছেন। অথচ অগণ্যের এই দ্যুতিময় কীর্তি চিহ্নের কোনও মূল্য দেয়নি এই মুলস্রোতের সমাজ রাষ্ট্র। কিন্তু ট্রেনের হাজার ঝামেলার মধ্যেও ঠিক ব্যালেন্স রেখে তারা গেয়ে চলেছেন রবীন্দ্র গান। তুখোড় তৃষ্ণা আর আকাঙ্ক্ষার গান নিয়ে আমার সামনে তখন দুটি সপ্রতিভ মানুষ। জিজ্ঞেস করি-আর একটা গান গাইবে না? শুরু হলো গান — ‘‘আলোকের এই ঝরনাধারায় ধুইয়ে দাও’’। এক অদ্ভুত প্রাণাবেগ রবীন্দ্রনাথকে অবলম্বন করে, প্রতিবন্ধকতাকে ছিন্ন করার প্রয়াস। রাত আটটার পর ওদের উনুনে নিশ্চয়ই টগবগ করে ভাত ফুটবে, একথা ভেবে প্রাণশক্তি পাই। 
গত ৩১ বছর মতো এ বছরও ৩ ডিসেম্বর বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে সমস্ত জেলার আন্দোলনের স্রোতে এসে মিলিত হবে রানি রাসমণি রোডে, সকাল দশটায়। এই মহতী সভায় আপনাদের সকলকে পেতে চাই অন্তরের টানে। শেষ করি কবি সুজিত সরকারের কবিতার কয়েকটা লাইন দিয়ে
সন্ধ্যার লোকাল ট্রেন।
অন্ধ ভিক্ষু লাঠি নিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ওঠে,
লাঠি দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে নামে,
লাঠি দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে কামরা বদল করে, ভিক্ষা চায়। 
লাঠির প্রকৃত শক্তি লেঠেল জানে না। অন্ধ জানে।
 

Comments :0

Login to leave a comment