Post Editorial

এই মৃত্যু মিছিলের দায় কার?

উত্তর সম্পাদকীয়​

শমীক লাহিড়ী


রাষ্ট্র যখন নাগরিকের কাছে তার অস্তিত্বের প্রমাণ চায়, তখন সেই প্রক্রিয়া হয় নথিপত্রের নরক। সামান্য কয়েকজন ‘অনুপ্রবেশকারী’ নামক কাল্পনিক শত্রুকে চিহ্নিত করার এই মহাযজ্ঞে যে খরচ হয়েছে, তার হিসাব শুধু কোটির অঙ্কে নয়— তা লেখা আছে অনেকগুলো লাশের কফিনে।
এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য নাকি অনুপ্রবেশকারীকে ধরা, কিন্তু তার ফল হলো সাধারণ নাগরিক, ভোটকর্মীদের মর্মান্তিক মৃত্যু। এই রাষ্ট্রীয় ঔদ্ধত্য এবং প্রশাসনিক অব্যবস্থার জন্য দায়ী কে? অবশ্যই নির্বাচন কমিশন। 
পর্বতের পিঁপড়ে প্রসব দেখা যাক, বিহারে এসআইআর’র অলৌকিক সাফল্য! বিহারে 
এসআইআর শুরুর আগে মোট ভোটার ছিল ৭.৮৯ কোটি (জুন ২৪, ২০২৫)। প্রথম খসড়া তালিকা থেকে বাদ পড়া ভোটার ছিল ৬৫ লক্ষ। খসড়া তালিকা প্রকাশের পর মোট ভোটার  হয়েছিল ৭.২৪ কোটি (আগস্ট ১, ২০২৫)। চূড়ান্ত তালিকায় নতুন নাম যুক্ত হয়েছিল ২১.৫৩ লক্ষ। অবশেষে খসড়া তালিকা থেকে আবেদন ও শুনানির পরে চূড়ান্ত তালিকায় নাম বাদ পড়েছিল ৩.৬৬ লক্ষ ভোটারের। যাদের বাদ দেওয়া হয়েছে তারা মৃত/স্থানান্তরিত/দু’বার নাম আছে/ভুয়ো। চূড়ান্ত তালিকায় মোট ভোটার দাঁড়িয়েছিল ৭.৪২ কোটি (সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৫)। 
এত বিশাল কর্মকাণ্ড, এত হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যয়ে তাহলে মাত্র ৩.৬৬ কোটি! এ তো পর্বতের ইঁদুরও নয়, পিঁপড়ে প্রসব! কমিশন না জানালেও সুপ্রিম কোর্টে যোগেন্দ্র যাদবের পেশ করা হলফনামায় দাবি করা হয়েছে, এত ধুমধামের পর নাকি মাত্র ৩৯০ জন 'বিদেশি' চিহ্নিত হয়েছেন!
মাত্র ৩৯০ জন! লক্ষ লক্ষ নাগরিকের হয়রানি, দিনের মজুরি নষ্ট, এবং রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হলো মাত্র ৩৯০ টা মাথা খোঁজার জন্য! এ অনুপ্রবেশকারী শনাক্তকরণ, না কি '৩৯০ জনকে খুঁজে বের করার জন্য মানুষের দেওয়া করের অপচয়ের ‘গিনেস রেকর্ড'? যদি সংখ্যাটা দশ হাজারও হতো, তবেও তা মোট বাদ পড়া ভোটারের ০.১৪ শতাংশ মাত্র! এই ০.১৪ শতাংশের জন্য দেশের ৯৯.৮৬ শতাংশ নাগরিকের জীবনযাত্রা পঙ্গু করে দেওয়া হলো! হিসাব অনুযায়ী, এই 'নাগরিক খোঁজার খেলা' চালাতে খরচ হয়েছে আকাশছোঁয়া অর্থ। 
যদি ১০০০ কোটি টাকাও খরচ হয়ে থাকে ৩৯০ জন অনুপ্রবেশকারীকে চিহ্নিত করতে, তাহলে মাথাপিছু বিদেশি খোঁজার খরচ ২ কোটি ৫৬ লক্ষ ৪১ হাজার ২৫ টাকা ৬০ পয়সা। জনগণের দেয় করের টাকায় এই ফাজলামি কেন? এটা অর্থনৈতিক অপরাধ নয়?
এই টাকা দিয়ে একেকটি রাজ্যের প্রতিটি গ্রামে একটি করে আধুনিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি হতে পারত। অথবা, হাজার হাজার স্কুল ড্রপআউট ছাত্রের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু না। রাষ্ট্র বেছে নিয়েছে এমন এক প্রক্রিয়া, যেখানে লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষ তাদের দিনের মজুরি নষ্ট করে, তাদের জীবনের সঞ্চয় ব্যয় করে ছুটছে জন্মস্থানের প্রমাণ, পিতার ভিটার দলিলের খোঁজে। আতঙ্কে ভুগছে দেশের সাধারণ নাগরিক! এর চেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় অন্যায় এবং অর্থনৈতিক অপচয় আর কী হতে পারে? 
গণতন্ত্রের ভাঁড়ামি
কী চমৎকার সহাবস্থান! এ যেন এক ত্র্যহস্পর্শ যোগ — কমিশন, সরকার এবং আরএসএস-বিজেপি। কমিশন, সরকার ও তাদের চালকরা মিলে প্রমাণ করেছেন, গণতন্ত্রের বধ্যভূমির তৈরি করাই তাদের কাজ! সেখানে লক্ষ লক্ষ নিরীহ আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের হয়রানি, বিএলও-দের মৃত্যু এবং দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার অপচয় ছাড়া আর কিছুই জন্ম নেয় না। একটি 'স্বাধীন' সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে কী করে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের 'রিমোট কন্ট্রোলড খেলনা' হিসাবে ব্যবহার করা যায়, তার মহৎ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, যার পোশাকি নাম এসআইআর। 
এই পুরো প্রক্রিয়াটি এক অসাধারণ পারফরম্যান্স আর্ট! যেখানে নির্বাচন কমিশন নামক স্বাধীন সংস্থাটি তাদের 'স্বায়ত্বশাসন'-এর টুপি খুলে রেখে, বিভাজনের রাজনীতির মঞ্চে নেমে পড়েছে। তাদের কাজ এখন আর অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নয়, বরং আরএসএস-বিজেপি’র নির্দেশ পালন করে 'বিভাজনের রাজনীতি'র চাষ করা।
সংবিধান হলো দেশের সর্বোচ্চ আইন। কিন্তু আজ স্পষ্ট, সংবিধান আসলে একটি সাধারণ পুস্তক মাত্র, যার পাতাগুলি ইচ্ছেমতো ছিঁড়ে ফেলা যায়, যদি তা আরএসএস-বিজেপি’র 'এক দেশ-এক নীতি-এক নেতা'র মহান লক্ষ্যের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
তাহলে দায় কার? দায় তাদের নয়— কারণ তারা তো মহান কর্তব্য পালন করছেন! আসল দায় হলো সেই কোটি কোটি মানুষের, যারা এখনও বিশ্বাস করেন যে কমিশন স্বাধীন, এবং এখনও এই 'স্বাধীনতার নাটক' মঞ্চস্থ করার জন্য মানুষেরই ঘামের টাকা লুটে নেওয়া হচ্ছে! আর এই পুরো ভাঁড়ামির জন্য ব্যয় হওয়া কোটি কোটি টাকা 'গণতন্ত্রকে বশে আনার গবেষণা খরচ'! এই গবেষণার ফলস্বরূপ গণতন্ত্র নিজেই এখন একটি শাসকের খাঁচায় 'বন্দি-পাখি'।
হয়রানির মহাকাব্য
এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে মর্মান্তিক দিকটি হলো কোটি কোটি মানুষের হয়রানি। কল্পনা করুন, একজন ৮০ বছরের বৃদ্ধা, যিনি জীবনে কোনোদিন নিজের গ্রামের বাইরে যাননি, প্রখর রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছেন শুধু একটি 'পেপার'-এর জন্য। এই 'পেপার' ছাড়া তার জীবন অচল। দরিদ্র, নিরক্ষর বা অর্ধশিক্ষিত মানুষের কাছে যখন তাদের পূর্বপুরুষের জন্মের শংসাপত্র চাওয়া হয়, তখন তা স্রেফ হয়রানি নয়— এ এক ধরনের ‘রাষ্ট্রীয় শয়তানি’। জন্ম-মৃত্যুর শংসাপত্র, ভোটার তালিকা, জমির দলিল— সবকিছু ঠিকঠাক রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। অথচ, আজ রাষ্ট্রই সেই দায়িত্বের বোঝা সাধারণ নাগরিকের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে তাদের হয়রানি করছে। এটা কি অনুপ্রবেশকারী ধরার প্রকল্প, না কি দেশের নাগরিকদের জীবনকে আতঙ্কগ্রস্ত এবং দুর্বিষহ করে তোলার নীল নকশা?
সংখ্যায় চাপা মনুষ্যত্ব
সবচেয়ে বড় আঘাত হলো এত মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু। কেউ মারা গেছেন লাইনে দাঁড়িয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে, কোনও বিএলও কাজের বোঝা ও মানসিক চাপ সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। আবার কেউ সঠিক কাগজ জোগাড় করতে না পারার হতাশায় জীবন দিয়েছেন। এই জীবনের দাম কত? রাষ্ট্রের খাতায় এরা হয়তো নিছক 'ফাইল মিসিং' বা 'প্রক্রিয়ার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া'! কিন্তু তাদের প্রত্যেকের একটি পরিবার ছিল, স্বপ্ন ছিল, জীবন ছিল। তাদের অমানুষিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা বা নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র হয়তো ছিল না, কিন্তু তাদের মনুষ্যত্ব ছিল। রাষ্ট্র তাদের কাছে কাজ অথবা কাগজ চায়নি, চেয়েছে তাদের জীবন। এই মৃত্যুর দায় তাদের উপরই বর্তায়, যারা কাগজকে জীবনের চেয়ে মূল্যবান করে তুলেছে।
দায়বদ্ধতার নাটক 
এই মহাযজ্ঞের ব্যর্থতা এবং মর্মান্তিক ফলাফলের পর কি কেউ দায় স্বীকার করেছেন? কমিশন কি ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছে? না। বরং চলেছে দায় চাপানোর নাটক। কখনও অনুপ্রবেশকারীর অজুহাত, কখনও পুরানো আইনের জটিলতা, আবার কখনও স্থানীয় প্রশাসনের ব্যর্থতার উপর দোষ চাপানো।
আসলে, পুরো প্রক্রিয়াটিই এমনভাবে রচিত হয়েছে যেন এর চূড়ান্ত দায় কখনও শীর্ষ নীতি নির্ধারকদের উপর না পড়ে। এ এক নির্মম প্রশাসনিক প্রহসন। এই আক্রমণাত্মক প্রক্রিয়া স্পষ্ট করে দেয় যে, সরকারের কাছে মানুষের জীবন নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং ভোট ব্যাঙ্কের অঙ্কই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
কাগজ যখন শৃঙ্খল
এই গোটা প্রক্রিয়াটি আমাদের শিখিয়েছে, রাষ্ট্র যদি চায় তবে যে কোনও সাধারণ নাগরিককেও এক মুহূর্তে 'বহিরাগত' বানিয়ে দিতে পারে। কাগজ খোঁজার এই মহাযজ্ঞ আমাদের দেখিয়ে দিল, নাগরিকত্ব কোনও জন্মগত অধিকার নয়, বরং ‘রাষ্ট্রের দয়াপ্রাপ্ত এক অস্থায়ী সুবিধা’ মাত্র। 
এত মৃত্যু, কোটি কোটি মানুষের হয়রানি এবং হাজার হাজার কোটি টাকার অপচয়— সবকিছুই প্রমাণ করে, এই প্রক্রিয়াটি কেবল একটি প্রশাসনিক ভুল নয়, এ এক ‘রাষ্ট্রীয় অপরাধ’, যা দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং মানুষের মৌলিক অধিকারের উপর তীব্র আক্রমণ। প্রশ্ন— এই ভুল সিদ্ধান্তের মর্মান্তিক হিসাবের জন্য দায়ী কে? দায়ী তারাই, যারা এই পরিকল্পনা করেছে, যাদের কাছে কাগজ জীবনের চেয়ে বেশি মূল্যবান।
লড়াই অধিকার রক্ষার
তবে এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। কাজকর্ম ফেলে পাগলের মতো কাগজপত্র খোঁজা অথবা কাজের চাপে দিশাহারা মানুষদের পাশে দাঁড়াড়ানোই এখন কমিউনিস্টদের শ্রেষ্ঠ 'রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিজম'। আমাদের লক্ষ্য একটাই, ত্রুটিপূর্ণ তালিকা এবং মৃত, ভুয়ো, স্থানান্তরিত, দু’জায়গায় নাম আছে এমন সব ভূতুড়ে ভোটারের নাম লিপিবদ্ধ করে তাদের বাদ দেওয়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া, ১৬ ডিসেম্বর খসড়া তালিকা প্রকাশের সাথে সাথেই। এই অন্ধকারের ষড়যন্ত্রে কোনও যোগ্য নাগরিকের নাম যেন বাদ না পড়ে — তা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার লড়াই চালানোই এখন আশু কাজ। এই যুদ্ধকে কেবল কাগজে সীমাবদ্ধ রাখলেই হবে না, এ হলো মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াই, এটাই আসল লড়াই।

 

Comments :0

Login to leave a comment